আরবের বাথ পার্টি: অখণ্ড আরব রাষ্ট্রের অধরা স্বপ্ন

বখতিয়ার আবিদ
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৪৮

আরব ভূখণ্ডের লোগো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আরব ভূখণ্ডের রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ বদলে যায়। যুদ্ধে বিজয়ী শক্তি আরব ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেন ছিল এই নিয়ন্ত্রণের মূলে। ফ্রান্সের হাতে লেবানন, সিরিয়া। ব্রিটেনের দখলে ইরাক। এই রাষ্ট্রগুলোতে তারা অনুগত শাসক নিয়োগ করল। খনিজ তেলে ভাসতে থাকা মধ্যপ্রাচ্য- ভূরাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, ফলে মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু তাদের মনবাসনায় বাগড়া দিল রাজনৈতিকভাবে সচেতন আরবের তরুণরা।
ইউরোপীয় ধারায় শিক্ষিত আরব তরুণদের বড় অংশই তখন সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তারা ছিল ব্যাপক সক্রিয়। ওই তরুণদের বিশাল অংশের ছিল একটু আলাদা রাষ্ট্র ভাবনা। তারা সমাজতান্ত্রিক দেশ চায়, কিন্তু তা গঠিত হবে সমস্ত আরব ভূমি নিয়ে। সিরিয়া থেকে ওমান, মরক্কো থেকে ইরাক পর্যন্ত হবে এই একক আরব রাষ্ট্রের বিশালতা। এই ভাবনা এবং তৎপরতার ফলে ব্রিটেন কিংবা ফ্রান্সের বসিয়ে দেওয়া পুতুল বাদশাহ ও আমিরের দল আতঙ্কিত হয়ে যায়। এতে করে ওই তরুণদের ওপর চলত নজরদারি, জেলে পুরে দেওয়া ছিল স্বাভাবিক ঘটনা।
কারা এবং কীভাবে বাথ পার্টির সৃষ্টি হলো তা জানতে হলে চলে যেতে হবে ১৯৩০ সালের প্যারিসে। সিরিয়ায় তখন ফ্রান্সের উপনিবেশ চলছে, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে দুজন সিরীয় তরুণ একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হলো। একজন সিরীয় খ্রিষ্টান মাইকেল আফলাক, অপরজন সালাহ আল দিন আল বিতর। দুজনই তখন ছাত্র। রাজনৈতিক মতাদর্শগত বোঝাপড়ায় ঐকমত্যে পৌঁছলেন তারা, তারপর সিরিয়া স্বাধীনতা লাভ করলে দেশে ফিরে আসেন। একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন উভয়ে। সেখানেই ১৯৪০ সালে তারা প্রতিষ্ঠা করেন একটি রাজনৈতিক দল, নাম- ‘আরব ইহইয়া মুভমেন্ট’।
সমসাময়িক সময়ে প্যারিস থেকে ফিরে জাকি আল আরসুজি নামের একজন বুদ্ধিজীবী ‘আরব বাথ পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল খুলেছিলেন। কিন্তু তিনি এবং তার দল শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করতে পারেননি। ধীরে ধীরে তার দলের লোকেরা মাইকেল আফ্লাকের দলে ভিড়তে থাকল। একপর্যায়ে জাকি আল আর সুজি তার দল নিয়ে আফ্লাক ও সালাহর দলে যোগদান করেন। দুটি দল মিলে ‘আরব বাথ মুভমেন্ট’ বা বাথ পার্টি নাম ধারণ করে। আফ্লাক আর সালাহ দলের সাংগঠনিক কাজকর্ম দেখার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, আর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দায়িত্ব পড়ল জাকি আল আর সুজির ওপর।
এখানে বলে রাখতে হয় যে, ‘বাথ’ আরবি শব্দ। যার বাংলা অর্থ ‘রেনেসাঁ’। বাথিজম সংযুক্ত আরব রাষ্ট্র গঠনের বার্তা নিয়ে এসেছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এই সকল ক্ষেত্রেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে মিলে যায় বাথ পার্টির। কিন্তু একটি জায়গায় ছিল পার্থক্য- আরব জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করেই সমাজতন্ত্র ও ধর্মরিপেক্ষতার একক আরব রাষ্ট্র গঠনই হলো বাথ পার্টির রাজনৈতিক লক্ষ্য। বাথ পার্টি সোভিয়েত বা চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে পছন্দ করত না। তারা নিজেদের স্বকীয় অবস্থান তৈরির চেষ্টা করেছিল। বাথ পার্টি এবং মিশরের গামাল আব্দেল নাসেরের তৎপরতায় ১৯৫৮ সালে ‘সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। মিশর, সিরিয়া আর ইয়েমেনের সমন্বয়ে গঠিত এই রাষ্ট্রটি টেকেনি বেশি দিন। ১৯৬১ সালে সিরীয়া একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং সংযুক্ত আরব যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে যায়। ১৯৬১-এর অভ্যুত্থানের পর সিরীয় সেনাবাহিনী একটি পুতুল সরকার বসায়।