
প্রতীকী ছবি
ফুলের মধ্যে ড্যাফোডিলের নাম জানেন না এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ড্যাফোডিল ফুল হিসেবে যেমন অনন্য তেমনি অনন্য এর নামকরণের ইতিহাস। ড্যাফোডিল ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইংরেজ কবি রবার্ট হ্যারিক লিখেছিলের তার বিখ্যাত কবিতা ফেয়ার ড্যাফোডিল। ফুল সৃষ্টিজগতের সৌন্দর্য, ভালোবাসা ও মায়ার প্রতীক হলেও সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির রহস্য উদঘাটন করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কবিও হয়তো কোনোভাবে বুঝতে পারেননি এই ফুল সৃষ্টির পিছনে রয়েছে এক যুবকের করুণ কাহিনি।
ড্যাফোডিল নার্সিসাস নামক গোত্রের একটি ফুল। গ্রিক পুরাণ অনুসারে এই ফুলের জন্ম নার্সিসাস নামের একজন অপূর্ব সুন্দর যুবকের দেহ থেকে। গ্রিক পুরাণের নদী দেবতা সিফিসাস এবং জলপরী লিরিউপির পুত্র নার্সিসাস। নার্সিসাসের জন্মের পর ছেলের আয়ুষ্কালের ব্যাপারে জানতে তার মা তাকে নিয়ে গেলেন এক অন্ধ ভবিষ্যৎ-বক্তা টাইরেসিয়াসের কাছে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার ছেলে কত দিন বাঁচবে?’ টাইরেসিয়াস বললেন, ‘এই ছেলে একটা লম্বা জীবন পাবে, যদি সে নিজেকে কখনো না দেখে।’ অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারী নার্সিসাসের রূপের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। আর এই রূপ মাধুর্যই তাকে অহংকারী আর আত্মগর্বিত যুবকে পরিণত করে। নার্সিসাস এতটাই সুন্দর ছিল যে যে কোনো মেয়ে, এমনকি পরীরাও দেখামাত্রই তার প্রেমে পড়ে যেত। কিন্তু নার্সিসাস ছিল প্রচণ্ড অহংকারী। সে কাউকেই নিজের যোগ্য বলে মনে করত না। অবশেষে এই অহংকার তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াল।
একদিন নার্সিসাস শিকার করে বাড়ি ফিরছিল, পথিমধ্যে ‘ইকো’ নামে এক পরী তাকে দেখে প্রেমে পড়ে যায়। ইকো কথা বলতে পারত না কিন্তু সে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তৈরি করতে পারত। প্রতিধ্বনির মাধ্যমে সে নার্সিসাসকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে, নার্সিসাসকে সে ভালোবাসে। সব বুঝতে পেরে নার্সিসাস তাকে সবার মতোই প্রত্যাখ্যান করে। দুঃখে কষ্টে ইকো পাহাড়ে পাহাড়ে কান্নার প্রতিধ্বনি তৈরি করতে থাকে এবং অবশেষে ইকো বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ।
নার্সিসাসের এরূপ আচরণ দেখে ক্ষুব্ধ হয় প্রতিশোধের দেবী নেমেসিস। সিদ্ধান্ত নেন কঠোর শাস্তি দেওয়ার। যেই ভাবা সেই কাজ, নার্সিসাসের ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেললেন দেবী।
একদিন বনে শিকার করতে যায় নার্সিসাস, হরিণ শিকার করার পর ক্লান্ত নার্সিসাসের প্রচুর তৃষ্ণা পায়। সে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য নদীতে পানি পান করতে যায়। পানি পান করতে গিয়ে নদীর পানিতে নার্সিসাস তার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। নিজের এত সুন্দর প্রতিচ্ছবি দেখে নার্সিসাস নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে যায়। প্রতিচ্ছবি ধরতে গিয়েও ধরতে পারে না।
নার্সিসাস নিজের রূপ স্পষ্টভাবে দেখেননি কোনোদিন। এই দেখাটাই তার জীবনে পরিণতি ডেকে আনে। সে বুঝতে পারেনি যে ওই প্রতিবিম্ব তারই এবং সঙ্গে সঙ্গেই সে তার প্রতিবিম্বের প্রেমে পড়ে গেল। নার্সিসাস নিচু হয়ে প্রতিবিম্বকে চুমো খেতে গেল। ওই প্রতিবিম্বও তাকে একইভাবে চুমু খেতে এলো।
সে মনে প্রাণে তাকে পেতে চায়। নার্সিসাস বনে বনে ওই ব্যক্তিকে খুঁজে বেড়ায় যার প্রতিচ্ছবি সে নদীর পানিতে দেখেছিল। তাকে না পেয়ে, দুঃখে কষ্টে নার্সিসাস খাবার খাওয়া ছেড়ে দেয় এবং প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে। একসময় তার শরীর ভেঙে পড়ে, তার সকল সৌন্দর্য ম্লান হতে থাকে। শারীরিক অসুস্থতায় ভুগতে ভুগতে নার্সিসাস মৃত্যুবরণ করে এবং মাটির সঙ্গে মিশে যায় তার দেহাংশ। আর ওই মাটিতেই জন্ম হয় নার্সিসাস ফুলের।
গ্রিক পুরাণের নার্সিসাস, কবি নজরুলের নার্গিস, ইংরেজ নিসর্গপ্রিয় কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘ড্যাফোডিল’ কবিতা সব একই মর্মার্থ বহন করে।
নার্সিসাসের এই স্বভাব থেকেই আত্মকেন্দ্রিকতা বা আত্মপ্রেম বোঝাতে ‘নার্সিসিজম’ শব্দটি চালু হয়েছে । নার্সিসাস কমপ্লেক্সে ভোগা মানুষরা এই মোহ সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে না। নার্সিসিজম মূলত পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার বা ব্যক্তিত্বের সংকট। এ ধরনের মানুষেরা এতই আত্মকেন্দ্রিক হয় যে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। একজন নার্সিসিস্ট মনে করেন তিনি বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যক্তি। সবার মনোযোগ থাকা উচিত তার দিকে।