
ইউক্রেন যুদ্ধ। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন, দক্ষিণ কোরিয়া ও পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দাবি, উত্তর কোরিয়া প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার সেনা রাশিয়ায় পাঠাচ্ছে, যা মূলত ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে। এর মধ্যে ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার অংশে প্রায় ৮ হাজার উত্তর কোরীয় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। তিনি সতর্ক করেছেন, মস্কো এই সেনাদের আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই যুদ্ধে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। উত্তর কোরীয় সেনাদের প্রথমে রাশিয়ার প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে মোতায়েন করা হয় এবং পরে বেশির ভাগ সেনাকে ইউক্রেন সীমান্তবর্তী কুরস্ক অঞ্চলে পাঠানো হয়।
কোরীয় সেনারা রাশিয়ায় যেসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে আর্টিলারি, ড্রোন, মৌলিক পদাতিক যুদ্ধকৌশল, এমনকি খন্দক পরিষ্কার কার্যক্রম। রাশিয়া তাদের ফ্রন্টলাইনে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে বলে ধারণা পশ্চিমা বিশ্লেষকদের। আর তাতে ইউক্রেন যুদ্ধে নতুন মোড় সূচিত হয়েছে। গত শতবর্ষের মধ্যে, অর্থাৎ ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বিপ্লব হওয়ার পর এবারই প্রথম দেশটির মূল ভূখণ্ডে বিদেশি সেনারা ঘাঁটি গাড়ল। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, এটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রথমবারের মতো বড় পরিসরে বিদেশি সেনা মোতায়েনের স্পষ্ট ইঙ্গিত। যুদ্ধের এই প্রসার ইউরোপের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বৃহত্তম স্থলযুদ্ধে পরিণত হতে পারে এবং কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
ওয়াশিংটনে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে ব্লিনকেন বলেন, উত্তর কোরীয় সেনাদের ব্যবহার করছে রাশিয়া, কারণ তারা এখন চরম সংকটে পড়েছে। পুতিন রাশিয়ার সেনাদের প্রাণঘাতী যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছেন। এখন তিনি উত্তর কোরিয়ার দিকে তাকাচ্ছেন, যা তার দুর্বলতার সুস্পষ্ট প্রমাণ। এ বিষয়ে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে দাবি ব্লিনকেনের।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধের ফলে কিয়েভ ও মস্কো উভয়ই এখন তাদের বাহিনী পুনরুদ্ধারে বিকল্প পথ খুঁজছে। কারণ তরুণদের জন্য বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগদানের বিষয়টি জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। কিয়েভের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রধান ওলেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কো বলেছেন, ইউক্রেন নতুন করে এক লাখ ৬০ হাজার সেনা নিয়োগ দেবে। কিংস কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক রামন পেচেকো পার্ডো মনে করেন, ‘উত্তর কোরিয়ার সেনারা রাশিয়াকে কৌশলগত ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে সক্ষম হবে। যদিও উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতা সীমিত, তবু এই যুদ্ধের বাস্তবিক পরিস্থিতিতে অংশগ্রহণ তাদের জন্য এক ধরনের নতুন অভিজ্ঞতা হবে। কিন্তু এতে কিছু সংকটও রয়েছে। এই যুদ্ধের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার সেনারা যুদ্ধে প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবে।’
উত্তর কোরিয়ার সেনারা তাদের নেতৃত্বের প্রতি অটুট আনুগত্য এবং মানসিক সহিষ্ণুতার জন্য প্রশংসিত। অবশ্য ইউক্রেনের মতো আধুনিক বাহিনীর কঠিন প্রতিরোধের মুখে তাদের যুদ্ধের মনোবল কতটা ধরে রাখতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সেন্টার ফর এশিয়া প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির সিনিয়র ফেলো এবং উত্তর কোরিয়ার সাবেক নাগরিক জি হিউন পার্ক বলেন, ‘উত্তর কোরিয়ার সেনাদের মানসিক প্রস্তুতি থাকলেও তাদের শারীরিক সহিষ্ণুতা বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য যথেষ্ট নয়।’
এই যুদ্ধ বাস্তবতার মধ্যেই উত্তর কোরিয়া সম্প্রতি একটি আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। এটি পুতিন ও কিম জং-উনের মধ্যে সম্ভাব্য চুক্তির ইঙ্গিত দিতে পারে, যার মাধ্যমে রাশিয়ার সমর্থনের বিনিময়ে উত্তর কোরিয়া সামরিক বা মহাকাশ প্রযুক্তি পেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, উত্তর কোরিয়া যদি রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয় তবে তারা বৈধ সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদমাধ্যম কেবিএসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, ‘উত্তর কোরীয় সেনাদের ইউক্রেন যুদ্ধে অংশগ্রহণ শুধু কয়েক দিনের ব্যাপার। পুতিন রাশিয়ার সেনাদের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে চাইছেন এবং এ জন্য উত্তর কোরীয় সেনাদের সামনে পাঠিয়ে তাদের ব্যবহার করবেন। এর মাধ্যমে পুতিন দক্ষিণ কোরিয়া ও ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়া যাচাই করছেন এবং এরপর তিনি এই মোতায়েন বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
ইউক্রেন যুদ্ধ কার্যত বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে বিভাজনরেখা আরো স্পষ্ট করেছে। একদিকে রয়েছে পশ্চিমা শক্তিগুলো, যারা ইউক্রেনকে অস্ত্র, গোলাবারুদ, ট্যাংক, যুদ্ধবিমান ও আকাশ প্রতিরক্ষা দিয়ে সহযোগিতা করছে। অন্যদিকে রয়েছে রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরানের মতো দেশগুলো। চীন এতদিন বাণিজ্য সহযোগিতা চালিয়ে আর্থিক নিষেধাজ্ঞায় কবলিত রাশিয়ার অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ইরান ড্রোন ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেছে। আর উত্তর কোরিয়া সেনা সদস্যদের পাঠিয়েছে যুদ্ধ করতে। আর এর মধ্য দিয়ে এ যুদ্ধ আরো বিস্তৃত হচ্ছে, যা অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বযুদ্ধেও রূপ নিতে পারে।