
বহু অমানবিক দৃশ্যের সাক্ষী ধাত্রী নুর মুয়ানি। ছবি: সংগৃহীত
আয়া আল-কাফারনার বয়স ২৮ বছর। তিনি ৩১ সপ্তাহের গর্ভবতী ছিলেন। গর্ভেই বাচ্চা মারা যায়। অপর্যাপ্ত খাবার, পরিষ্কার পানির অভাব, ওষুধ, চিকিৎসা পরিষেবার অপ্রতুলতা এবং সর্বতোভাবে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর থাকার জায়গার অভাবে তাকে একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। মৃত বাচ্চাটি অপারেশনের মাধ্যমে বের করতে গাজার একটি ক্লিনিকে পৌঁছান তিনি।
শারীরিক-মানসিকভাবে ভেঙে পড়া আয়া কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আমি প্রথমে ওর কথা শোনার পর একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করেছি। হয়তো এটা ভালোর জন্যই হয়েছে যে এই শিশুকে এ ধরনের দুর্দশায় জন্ম নিতে হবে না। হয়তো আল্লাহ তাকে এই কষ্ট থেকে রেহাই দিয়েছেন।’
এমন বহু অমানবিক দৃশ্যের সাক্ষী ২৭ বছর বয়সী ধাত্রী নুর মুয়ানি। মধ্য গাজার নুসাইরাত শরণার্থীশিবিরে বিপুলসংখ্যক মানুষের পালিয়ে আসা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের প্রথম তিন মাসে আমরা প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০টি নবজাতকের ডেলিভারির কাজ করতাম।
আমাদের সঙ্গে ছিল মাত্র ছয়জন ধাত্রী। তাদের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা কাজ করতাম।’ তিনি আরো বলেন, ‘ডেলিভারি রুমে আর জায়গা হচ্ছিল না। আমাদের মেঝেতে ও প্রসবপূর্ব প্রস্তুতির ঘরেও কিছু প্রসব করাতে হয়েছে।’ প্রায় তিন মাস ধরে তিনি বাড়ি যেতে পারেননি। হাসপাতালের চাপ এবং নুসাইরাতের আশপাশে চলাফেরা বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। তাই তাকে ওই সময়ে আল-আওদায় আটকে থাকতে হয়।
দেইর এল-বালাহের আল-আকসা মার্টায়ারস হাসপাতালকে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার জন্য মেটারনিটি ওয়ার্ড বন্ধ করে দিতে হয়। তখন আল-আওদা হয়ে পড়ে একমাত্র মাতৃসদন। এতে আল-আওদার ওপর চাপ বাড়ে। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নুর বলেন, ‘চারদিকে বোমা হামলা হচ্ছিল। লেবার রুমে নারীরা যে কী দুর্দশাপূর্ণ অবস্থায় ছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না! অনেক নারীর রক্তপাত বা মৃত প্রসবের মতো জটিলতা ছিল। তাদের বিশেষ যত্নের প্রয়োজন ছিল, যা এখানে সম্ভব ছিল না।’
যুদ্ধের তৃতীয় মাস ডিসেম্বরে নুর একটি ডেলিভারিতে অংশ নিচ্ছিলেন। তিনি শুনলেন যে তার ভাইকে ইসরায়েলি হামলায় গুরুতর আহত অবস্থায় আনা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় ভেঙে পড়েছিলাম। কারণ আমি কয়েক মাস ধরে আমার পরিবারকে দেখিনি। ভয় পেয়েছিলাম, তারা হয়তো ভাইয়ের মৃত্যুর খবর গোপন করছে। আমি চিৎকার করতে করতে হাসপাতাল থেকে দৌড়ে গেলাম। তার সারা শরীরে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন। আমি কাঁদছিলাম।’ তবে নুরের ভাই বেঁচেছিলেন এবং সুস্থ হয়ে ওঠেন। বোমা হামলার লক্ষ্য ছিল তারা যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তার পাশের বাড়ি। নুর বলেন, ‘অন্যসব পরিবারের মতো আমার পরিবার, আমার বাবা-মা এবং ৯ ভাই-বোন যুদ্ধের সময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল।’
এসব মর্মান্তিক ঘটনা নুরের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এখানে যে ধাত্রীরা আছেন, সবার একই অবস্থা। তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দীর্ঘ সময় এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। কষ্টের সময়গুলোতে তারা একে-অপরকে সান্ত¡না দিতেন।
যুদ্ধ চলার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে আসা প্রসবকালীন নারীদের সংখ্যা দিনপ্রতি প্রায় ১৫ জনে নেমে এসেছে। যে মায়েরা হাসপাতালে এসেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন একা। তাদের সঙ্গে থাকার মতো কেউ আর জীবিত ছিলেন না। নুর বলেন, ‘লেবার রুমে নারীরা তাদের শিশুর জন্মের আগমুহূর্তে সন্তান, স্বামী বা পরিবার হারানোর কথা বলে কাঁদছিলেন। এটি শিশু জন্মের প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। নবজাতকের মায়ের মানসিক সুস্থতা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তাদের জড়িয়ে রাখতাম। তাদের সঙ্গে কথা বলতাম, সান্ত¡না ও আশ্বস্ত করার চেষ্টা করতাম।’
নূর এক নারীর কথা স্মরণ করেন, যিনি স্বামী নিহত হওয়ার পরদিন প্রসববেদনা নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন। তার সন্তানের বাবাকে সবেমাত্র হত্যা করা হয়েছে, এমন এক জগতে একটি নতুন জীবনকে স্বাগত জানানোর মুখোমুখি হয়ে তিনি প্রসবের পুরো সময়ে হতবাক হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। নুর বলেন, ‘তার একটি পুত্রসন্তান হয়েছিল। নাম রাখা হয়েছিল স্বামীর নামে। কীভাবে শিশুর চাহিদা মেটাতে পারবেন, তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন ওই নারী।’
তিনি আরো বলেন, ‘কখনো কখনো সবেমাত্র ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে আনা হয় গর্ভবতী মায়েদের, সেগুলো ছিল আরো বেশি হৃদয়বিদারক ঘটনা। যখন কোনো নারীর মাথার পেছনে আঘাত লাগে, তখন জন্মদান প্রক্রিয়া অবিশ্বাস্যভাবে জটিল হয়ে যায়। এসব পরিস্থিতির কথা আমার প্রশিক্ষণ বা কোনো বইয়ে লেখা ছিল না।’