
মানবপাচারের প্রতীকী ছবি
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নৈহাটির এক মফস্বলে কণা রায়ের (ছদ্মনাম) বাড়ি। ছোট দোকানদার বাবার একার আয়ে চলা পরিবারে রয়েছে তিন বোন। এর মধ্যে কণা সবার বড়। বছর চারেক আগের কথা। করোনার প্রভাবে পরিবারে তখন তিন বেলা খাবার জুটত না। কণা তখন পড়ত নবম শ্রেণিতে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে ঘরে বসা মেয়েটির মনে শুধু মা-মরা ছোট বোনদের মুখে খাবার জোটানোর আশা। ভালো বেতনে কাজের আশায় বাড়ির কাউকে না জানিয়ে কণা পাশের বাড়ির এক নারীর কথায় পারি জমায় কলকাতায়। সেখান থেকে তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় মুম্বাইয়ে। পরে কণা কয়েক হাত বদলে পৌঁছান দুবাইয়ে। অনেক খোঁজ করার পরও তার কোনো হদিস মেলেনি।
২০২২ সালে এক লোক বাড়িতে গিয়ে তার খোঁজ জানায়। কণা তখন দুবাইয়ে ভারতীয় দূতাবাসের একটি সেইফ হোমে। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয় কণার। তিনি ফিরে আসেন। কণার পাচার হওয়ার ঘটনা তদন্তে নেমে পুলিশ একটি বড় পাচারকারী চক্রের সন্ধান পায়। কয়েকজন নারীকে উদ্ধারও করা হয়। তবে মূল পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। এমন কণাদের সংখ্যা ভারতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
নারী, শিশু, বয়স্ক ও সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ভারতে ১৯৯৩ সালে গঠিত হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। সম্প্রতি এই কমিশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশটি মানবপাচার রোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়নি। এর পেছনে রয়েছে আর্থিক বরাদ্দ, পরিকাঠামো ও প্রশিক্ষণের অভাব। পশ্চিমবঙ্গ একই সঙ্গে মানব পাচারের উৎস ও গন্তব্য। অন্যদিকে অন্ধ্র প্রদেশ ও রাজস্থান প্রধান উৎস এবং উত্তর প্রদেশ তথা দিল্লি গন্তব্য রাজ্য হিসেবে পরিচিত। মহারাষ্ট্র গন্তব্য ও হাব হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
সেন্টার ফর স্টাডিস ইন সোশ্যাল সাইন্সেসের গবেষক শৈবাল কর বলেন, ‘ভারতে বহু বিষয়েই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় অহরহ। একটি বড় সমস্যা হলো প্রশিক্ষণের অভাব। মানবপাচার একটি জটিল অপরাধ এবং এর তদন্ত করতে বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। অথচ এই ইউনিটে যারা নিযুক্ত হন, তাদের বেশির ভাগেরই বিশেষ প্রশিক্ষণ নেই। মানব পাচারের আইনি সহায়তা এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও অত্যন্ত জটিল। বিশেষ করে বিদেশ থেকে, পশ্চিমবঙ্গ বা উত্তর প্রদেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আর নেপাল থেকে, পাচার হওয়া নারীদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লেগে যায়। পাচার হওয়া মহিলা বা শিশুদের উদ্ধার করার জন্য আলাদা তহবিল না থাকায় পুলিশ কর্মকর্তারা অনেক সময় নিজেদের অর্থে অন্য রাজ্যে অভিযানে যান এমন নিদর্শনও রয়েছে। গ্রামে পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে লিফলেট বিলি করে পাচারবিরোধী প্রচারের কাজও হয়ে থাকে। তবে তা সমস্যা কমানোর পক্ষে যথেষ্ট মনে করার কারণ নেই।’
ভারতে উত্তর প্রদেশে পাচারের সংখ্যা বেশি। পাচার হওয়া নারীদের অনেকেরই ঠিকানা হয় এই রাজ্যের যৌনকর্মী হিসেবে। সমীক্ষায় জানা যায়, উত্তর প্রদেশে মূলত দলিত গোষ্ঠীভুক্ত কর্মকর্তাদেরই এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলে উচ্চবর্ণের কেউ পাচারে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে এই কর্মকর্তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বাধার সম্মুখীন হন। আবার থানাগুলোতে যেহেতু উঁচু বর্ণের পুলিশ দায়িত্বে থাকে; ফলে সেখানেও দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ অভিযোগই প্রয়োজন মোতাবেক গুরুত্ব পায় না। ভারতের ১৬টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে জেলাভিত্তিক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, এই ধরনের মানবপাচারবিরোধী ইউনিট অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধুই খাতা-কলমে রয়েছে। কাজে-কর্মে নেই এ রকম ইউনিটের সংখ্যা অন্তত ২২৫ এবং বলাই বাহুল্য দেশের ৮০০টি জেলার সব কটিতে এদের কোনো অস্তিত্বই নেই। স্থাপিত ইউনিটগুলোর মধ্যে মাত্র ২৭ শতাংশ কার্যকর।
জাতিসংঘের ড্রাগ ও আন্তর্জাতিক পাচার অপরাধসংক্রান্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ভারতে পাচার হওয়া মানুষের মধ্যে ৬৬ শতাংশ নারী, ১৩ শতাংশ নাবালিকা, ১২ শতাংশ পুরুষ ও ৯ শতাংশ নাবালক। ভারতে মানবপাচার ৩৭০-ক এবং পস্কো ধারায় গর্হিত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে কঠোর আইন দিয়ে তা রোধ করা সম্ভব নয়। এর পেছনে আর্থ-সামাজিক কাঠামো এবং সামাজিক মনস্তত্ত্বের পরিবর্তন ও সচেতনতা জরুরি। পাচার বন্ধ করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দেয়Ñপ্রতিরোধ, সুরক্ষা ও আইনানুগ সঠিক বিচার।
নারী পাচারের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কাজের টোপ দেখিয়ে, বিয়ের কথা বলে, সরকারি সাহায্য পাইয়ে দেওয়ার আশা দেখিয়ে পাচার করা। পরিকাঠামোর উন্নয়ন, নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দের মাধ্যমে পাচারবিরোধী কর্মকাণ্ড বেশি কার্যকর হতে পারে। এ ছাড়া পাচার হওয়া ব্যক্তিদের জন্য দ্রুত আইনি সহায়তা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। ভারতে মানবপাচার রোধ করতে হলে আর্থিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল অংশকে মূলস্রোতের উন্নয়নে শামিল করা দরকার বলে মনে করেন গবেষক সুমেধা দে।