
বোমার সঙ্গেই বান নাপিয়া গ্রামের মানুষের বসবাস। ছবি: সংগৃহীত
পাহাড় ও সমতলের মাঝে নৈসর্গিক দৃশ্যের মাঝে ডুবে থাকা সবুজে ঘেরা এক গ্রাম বান নাপিয়া। লাওসের জিয়াংখুয়াং প্রদেশে গ্রামটির অবস্থান। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছে এ গ্রাম। বোমার সঙ্গেই বান নাপিয়া গ্রামের মানুষের বসবাস। অনেক দিনের পুরনো বোমা এখনো পাওয়া যায় পথের আশেপাশে। কখনো বিস্ফোরিতও হয়। প্রাণ যায় মানুষের। বোমা বিস্ফোরণের ঝুঁকি নিয়েই পথ চলতে হয় এই গ্রামের মানুষকে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ (১৯৫৪-৭৫) ইতিহাসের একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের অধ্যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম ভিয়েতনাম, ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত চলে যুদ্ধ। যুদ্ধের সময় লাওসে মোট পাঁচ লাখ আশি হাজার টন বোমা ফেলেছিল মার্কিন বাহিনী। লাওস এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বোমাবর্ষণের শিকার হওয়া দেশ। তৎকালীন আমেরিকাসহ বিশ্বের কেউই লাওসের যুদ্ধাবস্থা সম্পর্কে জানত না। সবাই শুধু ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলছে এমনটাই জানত। ভিয়েতনাম যুদ্ধে কমিউনিস্ট গেরিলাদের সামরিক রসদের জোগান আসত লাওসের ভেতরকার ‘হো চি মিন ট্রেইল’ নামক রাস্তা দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র এই রসদ সরবরাহের রাস্তা বন্ধ করতে লাওসে ব্যাপক বোমাবর্ষণ শুরু করে, এই বোমার মোট পরিমাণ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বোমার থেকেও বেশি।
সমস্যার এখানেই শেষ নয়, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও দুর্ভোগ পিছু ছাড়েনি হতভাগ্য লাওসবাসীদের। লাখ লাখ বোমা অবিস্ফোরিত অবস্থায় থেকে যায়, যেগুলো এখন দুর্ঘটনাক্রমে বিস্ফোরিত হয়ে মানুষের প্রাণহানি-অঙ্গহানির কারণ হচ্ছে। যাদের অধিকাংশ শিকারই আবার শিশু। ২০১২ সাল পর্যন্ত এক হিসাবে দেখা যায় প্রায় ২৯ হাজার মানুষ এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হয়। পাইকারি হারে নিক্ষেপ করা ক্লাস্টার বোমাগুলোর (গুচ্ছবোমা) মধ্যে লাখ লাখ বোমা যুদ্ধের সময় অবিস্ফোরিত অবস্থায় থেকে গিয়েছিল, যেগুলো এখন দুর্ঘটনাক্রমে বিস্ফোরিত হয়ে মানুষের প্রাণহানি-অঙ্গহানির কারণ হচ্ছে।
ক্লাস্টার বোমার উদ্দেশ্যই হলো তৎক্ষণিক ক্ষতির পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদের ক্ষতি সাধন করা। এই বোমায় একটি বড় আকারের মূল বোমা শেলের ভেতরে ছোট ছোট শ’খানেক ক্ষুদ্র আকৃতির বোমা থাকে। বিমান থেকে নিক্ষেপের পর বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র বোমাগুলো বিশাল ব্যাসার্ধের একটি এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। কিছু বিস্ফোরিত হয়ে তাৎক্ষণিক প্রাণহানি ঘটায়, কিছু অবিস্ফোরিত অবস্থায় থেকে যায়। যেগুলো পরে ল্যান্ড মাইনের মতো কাজ করে। এ ছাড়াও বড় বড় আকৃতির অনেক ধ্বংসাত্মক বোমাও এখানে ফেলা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেসব বোমার অনেকগুলো অবিস্ফোরিত অবস্থায় থেকে যায়।
মূলত এই অবিস্ফোরিত বোমাগুলো লাওসবাসীর দুর্ভোগকে আরও হাজার গুণ বাড়িয়ে দেয়। কৃষকরা জমি চাষ করতে গিয়ে মাটির নিচে পরিত্যক্ত বোমার সন্ধান এখনও পায়, শিশুরা বনেবাদাড়ে খেলা করতে গিয়ে বোমা কুড়িয়ে পায়, জলাশয়ে কাজ করতে গিয়ে পানির নিচে বোমা পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরিত্যক্ত বোমাগুলো বিস্ফোরিত হয়ে প্রাণহানি বা অঙ্গহানি ঘটায়, যার অধিকাংশ শিকারই আবার শিশু। কিন্তু জীবন থেমে থাকে না, এখানকার মানুষ ভালোভাবেই মানিয়ে নিয়েছে এসব বোমার সঙ্গে।
বোমশেল কেটে দুই ভাগ করে বানানো হয়েছে ফুলের টব। কখনও আবার বড় আকারের বোমার খোল ব্যবহৃত হচ্ছে চুলা হিসেবে। একটু ভালো করে দেখলেই বোঝা যাবে ঘরের সীমানার বেড়া দেওয়া হয়েছে বোমার শেল দিয়ে। বিভিন্ন দোকানে তৈরি চামচ, হাতা থেকে শুরু করে অজস্র এন্টিকস সামগ্রী তৈরি হয়েছে পরিত্যক্ত বোমা থেকে।
লাওসের এই গ্রামের বাসিন্দাদের বোমার সঙ্গে দৈনন্দিন আর পাঁচটা জিনিসের মতো সম্পর্ক। যুদ্ধ শেষ হওয়ার চল্লিশ বছর পর এখনও বোমা বিস্ফোরণের ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয় তাদের। লাওস ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকদের অনেকেরই ভ্রমণ তালিকায় থাকে বম্ব ভিলেজ বাননাপিয়া।