ঝাড়খণ্ডে হিন্দুত্ব কার্ড হেরেছে, জিতেছে আদিবাসী-নারী ইস্যু

স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৭

ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। ছবি: দ্যা হিন্দু
ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) আবারও ঝড় তুলে জয়ী হয়েছে। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদি সরকার একের পর এক হিন্দুত্ব কার্ড খেলেছে, হেমন্ত সোরেনকে কারাগারে আটকে রেখেছে দুর্নীতির নামে। সেই সঙ্গে ঝাড়খণ্ডে বিজেপির তুরুপের তাস ছিল বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ইস্যু। তবে তা কোনো কাজে আসেনি। কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হেমন্ত-শিবির ঝাড়খণ্ডে পার করেছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অঙ্ক। আবারও হলেন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত।
তবে এ লড়াই যতটা দৃশ্যমান; তার চেয়ে বেশি কঠিন ছিল বলে জানান হেমন্ত। হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমরা হোমওয়ার্ক করেছিলাম। লড়াই কঠিন ছিল। তৃণমূল পর্যায়ে গিয়ে কাজ করেছি। ভালো টিম ওয়ার্ক ছিল। মানুষের কাছে আমরা আমাদের বার্তা পৌঁছাতে পেরেছি। লোকসভায় দেখেছিলেন, আমাদের রাজ্যে কীভাবে বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা ছড়ানো হয়েছিল। তখন কারাগারে ছিলাম। সেই সময় কারাগারের বাইরে থাকলে হয়তো ফলাফল অন্যরকম হতো। কল্পনা সোরেন (হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী) তখন ওয়ান ম্যান আর্মি হয়ে লড়েছেন। এবার তো দুজন ছিলাম।’
কারাগারে আটক রাখা প্রসঙ্গে হেমন্ত বলেন, ‘এটা ওদের পুরোনো পদ্ধতি। আমরা কিই বা বলতে পারি? মানুষ কার কথা শুনবে, সেটাই মূল কথা। আর তা কীভাবে বুঝবেন? ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুসম্পর্ক থাকা উচিত। আমরা গত পাঁচ বছর ধরে রাজ্যের দায়িত্বে আছি। আমাদের সরকারকে মানুষ দেখেছে। এটা আঞ্চলিক ভোট ছিল। অনেক ব্যাপার আছে। মানুষকে ভালো-মন্দ নিয়ে বহু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে। আর এর ফল আপনাদের সামনে।’
ইন্ডিয়া জোটের কাছ থেকে ঝাড়খণ্ড ছিনিয়ে নিতে বিজেপি চেষ্টার কসুর করেনি। ভোটের আগে থেকেই তারা ঠিক করেছিল, বাংলাদেশ থেকে ‘মুসলমান অনুপ্রবেশকে’ প্রধান হাতিয়ার করে তুলবে। সেই লক্ষ্যে নির্বাচন ঘোষণার আগেই বিষয়টি তারা বড় করে তুলে ধরেছিল। ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা লোকসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী বিজেপি সদস্য নিশিকান্ত দুবে পার্লামেন্টে এ বিষয়ের অবতারণা করে বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ঢুকে মুসলমানরা ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী-অধ্যুষিত এলাকার জনবিন্যাসে বদল ঘটিয়ে দিয়েছে।
লাভ জিহাদ থেকে শুরু করে অনুপ্রবেশ- সব হিন্দুত্ব কার্ডই খেলা হয়েছে ঝাড়খণ্ডে। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকে হাতিয়ার করে ঝাড়খণ্ডে প্রথম থেকেই সুর চড়িয়েছিল বিজেপি। ঝাড়খণ্ডে আদিবাসী জনসংখ্যা ২৬ শতাংশেরও বেশি। একাধিক আসনে ৪০ শতাংশের বেশি আদিবাসী ভোটার। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশে আদিবাসীরা জমি হারাচ্ছে বলে নির্বাচনী প্রচারে দাবি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি, অমিত শাহ, রাজনাথ সিংয়ের মতো বিজেপি নেতারা। মোদি স্লোগান দিয়েছিলেন ‘বেটি, রোটি, মাটি’ বাঁচানোর। তিনি বলেছিলেন, মুসলমান অনুপ্রবেশকারীরা ঝাড়খণ্ডে ঢুকছে। সেখানকার আদিবাসী নারীদের বিয়ে করছে, রাজ্যের মানুষের রুটিতে ভাগ বসাচ্ছে ও আদিবাসীদের জমি ছিনিয়ে নিচ্ছে। এভাবে তারা জনবিন্যাসেও বদল ঘটাচ্ছে। কিন্তু তা যে আদিবাসীদের মন গলাতে পারেনি তা ভোটে স্পষ্ট। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় একতরফাভাবে ঝাড়খণ্ড জনমুক্তি মোর্চার পথেই পালে হাওয়া লেগেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছে, আদিবাসীদের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ ইস্যুতেই বিজেপির বিরুদ্ধে খেলা ঘুরিয়েছেন হেমন্ত।
দুর্নীতির অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রী হেমন্তকে কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে ব্যুমেরাং হয়েছে। কারাগারে যাওয়ার আগে হেমন্ত মুখ্যমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আরেক আদিবাসী নেতা চম্পাই সোরেনকে। মুক্তি পাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রিত্ব ফিরিয়ে নিলে চম্পাই বিজেপিতে চলে যান। কিন্তু তাতেও আদিবাসী সমাজের ভোটে ভাগ বসাতে তারা ব্যর্থ। কারাগারে থাকাকালে হেমন্তের স্ত্রী কল্পনা দলের হাল ধরেছিলেন। এবারের ভোটে নারী সমর্থনও গেছে ইন্ডিয়া জোটের পক্ষে।
নারী ভোটারদের ওপর আগে থেকেই জোর দিয়েছিলেন হেমন্ত। রাজ্যের নারীদের জন্য ‘মাইয়া সম্মান যোজনা’ শুরু করেন তিনি। এই প্রকল্পের অধীনে রাজ্যের প্রত্যেক নারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে এক হাজার রুপি করে জমা পড়ে। নির্বাচনী ইশতেহারে সেই অঙ্ক বাড়িয়ে আড়াই হাজার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ঝাড়খণ্ড জনমুক্তি মোর্চা।