
পিটিআই নিষিদ্ধের দাবি পাকিস্তানে। ছবি: সংগৃহীত
রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সর্বশেষ বিক্ষোভ উচ্ছেদের পর এখন দেশটির কোনো কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী আবার দলটিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ উল্লেখ করছে। তারা পিটিআই নিষিদ্ধের দাবি জানাচ্ছে। তবে দেশটির অন্যতম বড় দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), জমিয়ত উলেমা-ই ইসলামের (জেইউআই) মতো কেউ কেউ এই নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতাও করছে। কার্যত পিটিআইয়ের ক্রমাগত আন্দোলন পাকিস্তানের গোটা সেনানিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাকে আঘাত করছে। তাই নিষিদ্ধের দাবি তোলা হচ্ছে।
কয়েক দিন আগে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে আইন পাস করে। এখন আদালত পার্লামেন্টের অধীন। রাজনৈতিক বা যৌক্তিক বিতর্কে যাওয়ার চেয়ে নিষিদ্ধ করে ফেলা সামরিক ব্যবস্থাপনার জন্য সহজ। আর যে দলগুলো পিটিআইকে নিষিদ্ধ করতে চায় তারা বুঝতে পারছে না, সামরিকতন্ত্রের ঘনিষ্ঠ হয়ে তারা যে ‘গণতান্ত্রিক’ প্রশংসাপত্রের অধিকারী বলে দাবি করে, তা থেকে তারা আরো দূরে সরে যাচ্ছে। তবে এতে রাজনীতি ও গণতন্ত্র আরেক দফা আক্রান্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত ২৮ নভেম্বর বেলুচিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ দিয়ে পিটিআই নিষিদ্ধের দাবি সামনে আসে। এতে নেতৃত্ব দেয় পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ)। বিরোধীদের ওয়াকআউটের মধ্যে ওই প্রস্তাব পাস হয়। পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদেও অনুরূপ একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল; কিন্তু পিপিপি বিরোধিতা করায় তা পাস হয়নি। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা খাইবারপাখতুনখোয়ায় (কেপি) গভর্নর শাসন জারি করার কথা বিবেচনা করছে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, নিষিদ্ধ করাটা মূলত সামরিক সংস্কৃতি। যে আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির (এএনপি) নেতা আইমাল ওয়ালি খান পিটিআইকে ‘বর্জ্য’ বলে উল্লেখ করে নিষেধাজ্ঞার কোরাসে যোগ দিয়েছেন; তার দাদা আব্দুল ওয়ালি খানের তৈরি দলটিও নিষিদ্ধ হয়েছিল সামরিক আদেশে। পাকিস্তানের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মাত্র দুটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। এর একটি ছিল ওয়ালি খানের নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ); তাদের ১৯৭৫ সালে নিষিদ্ধ করা হয়। পরে নাম বদলে এএনপি হিসেবে ফিরে আসে। অন্যটি হলো আওয়ামী লীগ। এটি নিষিদ্ধ করার বিপর্যয়কর পরিণতি পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যায়। ক্ষমতা দখলের পর স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হক পিপিপিকেও নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন এবং এটি থেকে কিছু উপদল তৈরিতে সহায়তা করেন। ভুট্টোর দলও অগণতান্ত্রিক নিষিদ্ধ ও বিভাজনের রাজনীতি কম সহ্য করেনি।
২ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডন পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘ইতিহাসের আলোকে বলা যায়, এসব নিষেধাজ্ঞা কাজ করে না। সব পক্ষই ভুল করে এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে কখনো কখনো হিংসাত্মক সংঘর্ষও হতে পারে; কিন্তু জনসাধারণকে তাদের ইচ্ছামতো সংগঠনে সংগঠিত হওয়ার যে সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে, তা অস্বীকার করে নিষিদ্ধকরণকে ন্যায্যতা দেওয়ার উপায় নেই।’ কার্যত এই নিষেধাজ্ঞা সামরিকতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করবে।
প্রসঙ্গত, ইমরান খানের মুক্তি, সরকারের পদত্যাগ এবং সংবিধানের ২৬তম সংশোধনী বাতিলের দাবিতে গত ২৪ নভেম্বর ইসলামাবাদ অভিমুখে রওনা দেন পিটিআইয়ের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। ২৭ নভেম্বর তারা ইসলামাবাদের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ডি-চকের কাছাকাছি পৌঁছান। ইসলামাবাদের রেড জোন এবং ডি-চকে পৌঁছানোর পর পুলিশ, রেঞ্জার্স ও সেনা সদস্যদের হাতে ব্যাপক ধরপাকড়ের শিকার হন পিটিআইয়ের নেতাকর্মীরা। সংঘাতে পুলিশ, রেঞ্জার্স ও পিটিআইয়ের মোট ছয়জন নিহত হন। আহতের সংখ্যা সহস্রাধিক বলে জানা গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানীজুড়ে আগে থেকেই সেনা মোতায়েন করেছিল সরকার। পিটিআই কর্মী-সমর্থককে দেখামাত্র গুলির নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। তবে সেনা সদস্যরা সরাসরি সংঘাতে যাননি।
সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন কর্মসূচির শীর্ষ দুই নেতা খাইবারপাখতুনখোয়ার মুখ্যমন্ত্রী আলী আমিন গান্দাপোর এবং ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবিকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২৭ নভেম্বর রাতে বিক্ষোভ কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় পিটিআই।
এমনিতে মামলার পাহাড় জমেছে এ যাবৎকালে পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ইমরানের বিরুদ্ধে। এ আন্দোলন কর্মসূচির পর ইমরান, তার স্ত্রী বুশরা বিবি এবং বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আটটি নতুন মামলা দায়ের হয়েছে ইসলামাবাদের বিভিন্ন থানায়। আন্দোলন সফল না হলেও ইমরানের জনপ্রিয়তা কমেনি; তবে সফলতার জন্য পিটিআইকে নতুন কৌশল ভাবতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।