
প্রতীকী ছবি
বিশ্ব অর্থনীতি যখন কোভিড-১৯ সংকট কাটিয়ে উঠছিল, তখনই শুরু হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। ২০২২ সালে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ও মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায়। প্রায় সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়ে দেয়। ধারণা করা হচ্ছিল, ২০২৩ সালের শেষে বা ২০২৪ সালের শুরুতে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিগুলোতে মন্দা দেখা দিতে পারে। তবে ২০২৪ সালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে এলেও বিশ্ব অর্থনীতি হয়ে উঠে স্থিতিশীল। বৈশ্বিক মন্দা এড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সফলতা দেখিয়েছে বিশ্ব। ফলে ২০২৪ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার কমাতে সক্ষম হয়। যদিও বাংলাদেশসহ কিছু দেশে মূল্যস্ফীতির হার বেশি।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দুই দশকের মধ্যে দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। করোনা-পরবর্তী পুনরুদ্ধারে এসব দেশ ব্যর্থ হয়েছে। ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের (ইসিবি) প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্ড বছরের চূড়ান্ত বৈঠকের পরে জানিয়েছে, ২০২৫ সালে ব্যাপক অনিশ্চয়তা থাকবে।
অর্থনীতিবিদ ও মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের সাবেক ‘আন্ডার সেক্রেটারি’ নাথান শিটস বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে চলছে, তাতে হতাশ হওয়ার মতো অনেক কারণই আছে।’ ৬০টির বেশি দেশে নির্বাচন হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে মার্কিন কোম্পানি সিটি গ্রুপের এই প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমার কাছে রাজনৈতিক পরিবেশ স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে অনিশ্চতায় ভরা মনে হচ্ছে।’ অনেকের মতে, এই অনিশ্চয়তার প্রধান উৎস হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফিরে আসা।
২০২৪ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মতো যুগান্তকারী প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে। বছরের শেষ ভাগে ট্রাম্প আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় আরোহণের আগেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য আমদানিতে শুল্কহার বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন। চীনা পণ্যে ৬০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি এবং প্রতিবেশী কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। অন্যান্য দেশের ওপর বিভিন্ন হারে শুল্ক আরোপ করবে তার প্রশাসন। এর প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে ব্যাহত হতে পারে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা।
উচ্চহারে শুল্ক আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। বহুজাতিক বিনিয়োগকারী মার্কিন ব্যাংক ‘গোল্ডম্যান স্যাক্স’ আভাস দিয়েছে, ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলেও তা মার্কিন জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই প্রভাব সবচেয়ে প্রকট হবে ২০২৬ সালে গিয়ে। ভোক্তা ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে মার্কিনিদের মধ্যে ব্যয় সংকোচনের প্রবণতা বেড়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ বিশ্ব অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা অনেকটা নির্ভর করবে ভুক্তভোগী দেশগুলোর পাল্টা পদক্ষেপের ওপরও। কারণ অনেক দেশ মার্কিন পণ্য আমদানিতেও অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিনিয়োগকারী কোম্পানি জেপি মরগ্যান আশঙ্কা করছে, ট্রাম্প সবার ওপর ‘নির্বিচারে’ শুল্ক আরোপ না করলেও চীনের মতো কয়েকটি দেশ নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশটি সম্পর্কে গত মাসে গোল্ডম্যান স্যাক্সের বিশ্লেষকরা বলেন, ‘চীনের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়বে এবং তারা প্রায় নিশ্চিতভাবেই শুল্ক আরোপের মুখে পড়তে যাচ্ছে।’
চীন আগে থেকেই জানিয়েছে যে, তারা শুল্ক আরোপের বিপরীতে পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে মার্কিন বেশ কিছু প্রযুক্তি নির্মাতা কোম্পানির ওপর শুল্ক আরোপ করবে; যারা চীনা ব্যাটারি ও অন্যান্য যন্ত্রাংশের ওপর নির্ভরশীল। মার্কিন কোম্পানিগুলোর উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই বোঝা বাড়বে ভোক্তার। আর অতিরিক্ত দামে কোনো পণ্য কিনলে স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
এদিকে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া এবং বাজারে তেলের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় নানা উত্তেজনার মধ্যেও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম কমেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০২৫ সালে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারে নেমে যেতে পারে। জ্বালানি তেলের দামের প্রভাব পড়ে বাজারের সব পণ্যের ওপর। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির হার কমে আসার পেছনে তেলের বাজার পড়ে যাওয়ার একটা বড় প্রভাব আছে।
অনেক দেশের রাজনীতিতে চলতি বছর বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের গণহত্যা ও লাগাতার বিভিন্ন দেশে আগ্রাসন বিস্তৃত করার সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হচ্ছে। সেই সঙ্গে এর প্রভাবে বিঘ্ন ঘটতে পারে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে। তবে অচিরেই তা ঘটছে না। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের বড় অর্থনীতির দেশগুলো এতে নিশ্চিতভাবেই আক্রান্ত হচ্ছে ও হবে। বিশ্লেষক নাথান বলেছেন, ‘বর্তমান সংঘাতের যে মাত্রা, তাতে জ্বালানি তেলের সরবরাহ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই। সংঘাতের বিস্তৃতি ঘটতে পারে; কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বড় অর্থনীতির দেশগুলো তা আর বাড়াতে চায় না।’