
পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে সংঘাত। ছবি: সংগৃহীত
২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলে পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক সংস্থা উচ্ছ্বসিত ছিল। তবে গত তিন বছরে পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গেছে। দেশ দুটির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে প্রায়ই উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হচ্ছে। সীমান্তের দুই দিকে নিয়মিত পাল্টাপাল্টি হামলা হচ্ছে। আর এর ফলাফলও দীর্ঘমেয়াদি।
সম্প্রতি খোস্ত প্রদেশে বিরোধপূর্ণ ডুরাল্ড লাইনের কাছে আলী শের ও জাজিয়া ময়দান এলাকায় নতুন করে সংঘর্ষ হয়, যা পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সরকারের মধ্যে সীমান্ত অঞ্চল নিয়ে বিরাজমান উত্তেজনাকে আরো তীব্র করেছে। উভয় পক্ষই একে-অপরের বিরুদ্ধে সীমান্ত লঙ্ঘনের অভিযোগ করছে। ২ জানুয়ারি মধ্যরাত থেকে ৩ জানুয়ারি সকাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের খোস্ত প্রদেশের আলী শের বিভাগে রকেট হামলা চালায় পাকিস্তান। এর জবাবে তালেবান বাহিনীও পাল্টা হামলা চালিয়েছে। এর আগে গত ২৪ ডিসেম্বর আফগানিস্তানের পাকতিয়া প্রদেশে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তান। এতে নারী, শিশুসহ অন্তত ৪৬ জন নিহত হয়। পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের দাবি, সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) সদস্যরা আফগানিস্তানের পাকতিয়া প্রদেশে অবস্থান করছেন এবং আফগান তালেবান টিটিপির সদস্যদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন। এই হামলার জবাব দিতে তালেবান সেনারা পাকিস্তানের কয়েকটি সীমান্ত চৌকিতে হামলা চালান। এতে ১৯ পাকিস্তানি সেনা নিহত হন বলে দাবি করেন তারা।
আফগানিস্তানে টিটিপির উপস্থিতি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে গত তিন বছর ধরে উত্তেজনা বাড়ছে। টিটিপির সঙ্গে আফগান তালেবানের আদর্শগত সম্পর্ক রয়েছে। জঙ্গিগোষ্ঠীটির হামলা নিয়ে ইসলামাবাদের উদ্বেগ রয়েছে। তালেবান টিটিপি জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করলেও জাতিসংঘের একটি পর্যবেক্ষণ গ্রুপের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, আফগানিস্তানে টিটিপির প্রায় ছয় হাজার সদস্য রয়েছে।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ অভিযোগ করেন, ২০২২ সালে আফগানিস্তান সফরের সময় তালেবান কর্মকর্তারা টিটিপি যোদ্ধাদের সীমান্ত থেকে সরিয়ে দেওয়ার কাজে সহায়তার জন্য ১০ বিলিয়ন রুপি দাবি করেন। তিনি দাবি করেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা ইয়াকুব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজুদ্দিন হাক্কানি এবং উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা শিরিন আখুন্দসহ তালেবানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠকে এই তহবিলের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। তবে তালেবান নিয়ন্ত্রিত ন্যাশনাল রেডিওতে তালেবানের উপমুখপাত্র হামদুল্লাহ ফিতরাত পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফের মন্তব্যকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, তালেবান পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে এই বিষয়ে কোনো আলোচনা বা চুক্তিতে পৌঁছায়নি।
তবে তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের শিকড় অনেক গভীরে। জেনারেল জিয়া-উল-হকের শাসনামলে পাকিস্তানের সামরিক আমলাতন্ত্র নিজস্ব গোষ্ঠী স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সঙ্গে মিলে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বারবার হস্তক্ষেপ করেছে। তখন পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সঙ্গে মিলে তেহরিক-ই-তালেবান আফগানিস্তান (টিটিএ) সদস্যদের নিজেদের অঞ্চলে নিরাপদে আশ্রয় দেওয়াসহ সব উপায়ে সহযোগিতা করেছে। এখন তারা নিজ দেশে ও আফগানিস্তানে একই শক্তির বিরুদ্ধে বোমা ফেলছে এবং কাবুলের কাছে টিটিপির বিরুদ্ধে সহযোগিতার দাবি জানাচ্ছে। ২০২১ সালের আগপর্যন্ত টিটিপির পাকিস্তানি মুজাহিদরা ন্যাটোবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এখন তাদের এক কথায় সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়-এটা তালেবান ভালো করেই জানে।
এখানে এক জটিল সমীকরণ রয়েছে। টিটিএর মতো টিটিপিও দেশটির অনেক সশস্ত্র সংগঠনের একটি জোট। এতে আছে লস্কর-ই-ইসলাম, মাজার বালুচ গ্রুপ, জুন্দাল্লাহা, জামাতুল আহরার, রশিদ শহিদ ব্রিগেড, মুসা শহিদ গ্রুপ, আমজাদ ফারুকি গ্রুপ, হাকিমুল্লাহ মেহসুদ গ্রুপ ও তেহরিক-ই-পাঞ্জাব ছাড়া আরো ৯টি গোষ্ঠী। এর অন্তত দুটি গ্রুপ চীনের উইঘুর ও উজবেকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করছে। এসব গেরিলা সংগঠনের বাইরেও পাকিস্তান-আফগানিস্তানে সক্রিয় রয়েছে ইসলামিক স্টেট খোরাসান (আইএসকে), যা ইরাক-সিরিয়াভিত্তিক আইএসের দক্ষিণ এশিয়ার শাখা হিসেবে পরিচিত।
তালেবান যদি পাকিস্তানের অনুরোধ বা চাপ মেনে টিটিপিকে নিয়ন্ত্রণ করতে যায়, তখন সেই সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট তাদের কর্মীরা আইএসকের সমর্থক বনে যেতে পারে। এমনও হতে পারে যে, অনেকে প্রকাশ্যে কাবুল সরকারের নির্দেশনা মানলেও গোপনে আইএসকের সাহায্যকারী হয়ে থাকবেন। কাবুল সরকারের জন্য এটা এক জটিল পরিস্থিতি।
এটা ঠিক যে, তালেবান সরকারের আশ্রয় ও সহযোগিতা ছাড়া পাকিস্তানের ভেতর টিটিপি সশস্ত্র তৎপরতা চালাতে সক্ষম নয়। টিকে থাকার সংগ্রামে টিটিপি ও আইএসকের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়তে পারে। কাবুল সরকার একা নয়; পাকিস্তানের অঘোষিত ক্ষমতাসীন সেনাবাহিনীও সংকটে রয়েছে। দেশের ভেতর ইমরান খানকে কারাবন্দি রাখা নিয়ে জনগণ ও বহির্বিশ্বে তাদের ভাবমূর্তি তলানিতে। আফগানিস্তানের পাশাপাশি ইরানের সঙ্গেও পাকিস্তানের সামরিক পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটেছে কয়েক মাস আগে। ফলে ইসলামাবাদকে ভারত সীমান্তের পাশাপাশি ইরান ও আফগানিস্তান সীমান্তেও বড় আকারে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে হচ্ছে। এটা তাদের সামরিক ব্যয়ভার বাড়াচ্ছে। পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকরা বরাবরই আফগানিস্তানে তাদের পোষ্য সরকারের কামনা করেছে। তালেবান শাসনামলেও সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বিরোধের এটাও একটা বড় দিক। আর এর ফলে লাভবান হচ্ছে ভারত। তালেবানের ক্ষমতা দখলের ফলে ভারতে ধর্মীয় বা জাতিগত সংঘাতে কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে ইরান ও আফগানিস্তানের সংঘাতের ফলে দেশ দুটির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক লেনদেন বাড়ছে।