গ্রিনল্যান্ড কি রেহাই পাবে: কিনতে মরিয়া ট্রাম্প

অরুন্ধতী সুরঞ্জনা
প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:২৩

গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার ইচ্ছা ডোনাল্ড ট্রাম্পের। ছবি: সংগৃহীত
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচিত না হলে কার কী লাভ হতো, তা বলা মুশকিল। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ এমন মোড়ে গিয়ে জট পাকিয়েছে, বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড চোখে সর্ষে ফুল কিংবা ললাটে লাল অক্ষরের বিপদ লিখন দেখতে পাচ্ছে। কারণ ট্রাম্প নতুন মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের আগে আবার গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার ‘ইচ্ছা’ পোষণ করেছেন। এর আগে তিনি তার প্রথম মেয়াদে ২০১৯ সালে একই ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। তখন এই দ্বীপের নিয়ন্ত্রক ডেনমার্ক ট্রাম্পের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, তাদের রাষ্ট্রের অংশ এই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বিক্রি হওয়ার নয়। এবারও তা-ই করবে। কিন্তু এই দ্বীপ কেন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিতে চান ট্রাম্প? গ্রিনল্যান্ডের স্থানীয়রা কীভাবে দেখছেন পুরো বিষয়কে?
এমন একটি জায়গা কী কারণে কিনতে চান, সে বিষয়ে ট্রাম্প নিজে মুখ ফুটে কিছু বলেননি। তবে বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে সিএনএনের এক প্রতিবেদনে। ট্রাম্পের আগ্রহের পেছনে রয়েছে দ্বীপটির প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব। গ্রিনল্যান্ড বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। রয়েছে লোহা, আকরিক, সিসা, দস্তা, হীরা, সোনা, ইউরেনিয়াম, তেলসহ বিরল সব প্রাকৃতিক উপাদান। এই দ্বীপের ৮০ শতাংশ অঞ্চল তুষারাবৃত। মাত্র ৬০ হাজার লোকের বাস এই দ্বীপে। তুষারাবৃত স্থানগুলো কেউ এখনো ব্যবহার করতে পারেনি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে দ্বীপটির বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে। দ্বীপটির বরফ গলার ফলে সেখানকার ভূমি ব্যবহারের সুযোগ বাড়বে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের অপার সম্ভাবনাও উন্মোচিত হবে। এ কারণেই ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড কেনায় ঝুঁকতে পারেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের ডেনমার্কের ওই দ্বীপ কেনার পেছনে ভূ-রাজনৈতিক কারণও থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে একটি সেনাঘাঁটি স্থাপন করেছে। আর্কটিক সার্কেলের সাড়ে ৭০০ মাইল উত্তরে অবস্থিত ওই সেনাঘাঁটি আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন। সেখানে একটি রাডার স্টেশন রয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রিম ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সতর্কব্যবস্থার একটি অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারফোর্স স্পেস কমান্ড ও নর্থ আমেরিকান অ্যারোস্পেস ডিফেন্স কমান্ডও সামরিক ঘাঁটিটি ব্যবহার করে থাকে। ইউরোপে সামরিক শক্তি বাড়াতে গ্রিনল্যান্ড কেনার চিন্তাভাবনা করতে পারেন ট্রাম্প।
‘ড্যানিশ ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’-এর জ্যেষ্ঠ গবেষক আলরিক প্রাম গাদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই গ্রিনল্যান্ডের মালিকানাকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়, বিশেষ করে রাশিয়া থেকে হামলা ঠেকানোর ক্ষেত্রে। জাহাজ চলাচলের পথ ‘দ্য নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ’ গ্রিনল্যান্ড উপকূল হয়ে গেছে। আর এই দ্বীপ কৌশলগত সামুদ্রিক এলাকা গ্রিনল্যান্ড-আইসল্যান্ড-যুক্তরাজ্যের অংশ।
গ্রিনল্যান্ডকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য শুল্ক আরোপের কৌশল অথবা সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে তিনি প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন ট্রাম্প। তার মন্তব্যের জেরে গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিউট এগেদে বলেছেন, ‘গ্রিনল্যান্ডের মালিক গ্রিনল্যান্ডবাসী।’ ট্রাম্প এমন একসময়ে গ্রিনল্যান্ড অধিকার বা অধিভুক্ত করার কথা বললেন, যখন ডেনমার্কের কাছ থেকে দ্বীপটির স্বাধীনতা অর্জন নিয়ে একটি বিতর্ক চলছে এবং প্রধানমন্ত্রী এগেদে স্বাধীনতার পক্ষে। ২০১৯ সালে কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জরিপে দেখা গেছে, গ্রিনল্যান্ডের প্রাপ্তবয়স্কদের ৬৭.৭ শতাংশ মানুষ ভবিষ্যতে কোনো না কোনো সময় ডেনমার্কের অধীনতা থেকে স্বাধীন হতে চায়।
ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড কেনার খবরে স্থানীয়দের মত প্রতিফলিত হয়েছে দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে। একজন বলেছেন, ‘আমাদের দেশ আমাদের। এটা বিক্রির জন্য নয়।’ একজন বলেছেন, ‘আমাদের অধিভুক্ত করার কথা একই সঙ্গে ভয়ংকর ও হাস্যকর। ট্রাম্প যদি সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেন, তার অর্থ দাঁড়াবে বাদবাকি ন্যাটো সদস্যদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করা।’ আরেকজন বলেছেন, ‘আমরা ডেনমার্ক থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে চাই। তবে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের অধীন হতে চাই না।’
গ্রিনল্যান্ড ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ডেনমার্কের একটি উপনিবেশ ছিল। বর্তমানে এটি ডেনমার্কের অধীনে থাকা একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। ২০০৯ সালে ভোটের মাধ্যমে দ্বীপটি স্বাধীনতা দাবি করার অধিকার অর্জন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নাৎসি বাহিনী ডেনমার্ক অধিকৃত করলে যুক্তরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ড দখল করেছিল। ১৯৪৫ সালে দ্বীপটি ডেনমার্কের কাছে ফেরত দেওয়া হয়। দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।