
ট্রেন বাঁশেরও হয়। ছবি: সংগৃহীত
শিরোনামটা নিশ্চয় চমকে দিয়েছে। ট্রেনের কথা চিন্তা করলেই ইস্পাতের বেশ কয়েকটি বগির সেই পরিচিত চেহরাটি ভেসে ওঠে। সেই ট্রেন বাঁশের হয় কীভাবে? কিন্তু সত্যি এমন আশ্চর্য বস্তু আছে। আর এটি মোটেই কোনো খেলনা ট্রেন নয়। চলে সত্যিকারের রেললাইন ধরে। যাত্রীও বহন করে। তবে এর দেখা পেতে আপনাকে যেতে হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ায়।
অদ্ভুত এই যানটিকে প্রথম দেখলে চোখ কপালে উঠবে যে কারো। ছোট্ট একটা বাঁশের কাঠামোর ওপর বসে আছে ১০-১২ জন। দিব্বি ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলেছে রেললাইন ধরে। কম্বোডিয়ার এই বিখ্যাত বাঁশের ট্রেন বা ব্যাম্বু ট্রেন স্থানীয়ভাবে পরিচিত নরি নামে। তবে নরির দেখা পাবেন শুধু বেটামবাং প্রদেশে।
নরি দেখতে কেমন এ সম্পর্কে একটু ধারণা দেওয়া যাক। শরীর বা বডি মূলত বাঁশ দিয়ে তৈরি একটি পাটাতন। একে শক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয় ধাতব একটা পাত। চাকা ইস্পাতের। ছোট্ট একটি মোটর থাকে একে চালানোর জন্য। পরিত্যক্ত ট্যাংক ও লরি থেকে সংগ্রহ করা হয় আজব এ ট্রেনের চাকা ও এক্সেল।
সাধারণত ব্যবহার করা হয় মোটরসাইকেল কিংবা ট্রাক্টরের পুরোনো ইঞ্জিন। বসার জায়গাটি বাঁশের হওয়াতেই নরির পাশাপাশি ব্যাম্বু ট্রেন বা বাঁশের ট্রেন নামটাও বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
বাঁশের ট্রেন যান হিসেবে বেশ অদ্ভুত হলেও এর চল শুরু হওয়ার পেছনের ইতিহাসটা মোটেই মজার নয়। ১৯৭০-এর দশকে গৃহযুদ্ধ ও খেমাররুজের শাসনের সময় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে কম্বোডিয়ার জাতীয় রেলরোড। ১৯৮০-র দশকে পুনরায় শুরু হয় ট্রেন চলাচল। তবে চলতে থাকা গেরিলাযুদ্ধে দেশের বিভিন্ন অবকাঠামোর অবস্থা তখন সঙ্গিন। রাস্তাগুলো বেহাল। ট্রেন চলাচল কমতে কমতে আবার বন্ধ হয়ে যায়। বলা চলে এই অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়ে। আর এই সমস্যার সহজ এক সমাধান বের করে স্থানীয়রা, সেটিই ব্যাম্বু বা বাঁশের ট্রেন।
বেটামবাংয়ের পরিত্যক্ত লাইনগুলোর ওপর চলা এই আজব ট্রেন অচিরেই প্রদেশের ছোট ছোট গ্রামগুলোর মধ্যে যাতায়াতে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। মানুষের পাশাপাশি নানা মালামাল এমনকি গবাদি পশুও পরিবহন করে এটি।
বড় সুবিধা হলো এক লাইনেই দুই দিক থেকে আসতে পারে দুটি নরি। কিন্তু যখন দুটি নরির দেখা হয়ে যায়? সমাধান সহজ। হালকা নরিটার মালামাল খালাস করে ওটাকে লাইনের পাশে নিয়ে আসা হয়। এতে অন্য নরিটা চলে যেতে পারে। তারপর আবার এটাকে লাইনে তুলে মালামাল ও যাত্রী তুলে স্টার্ট দেওয়া হয়। পুরো প্রক্রিয়াটিতে সময় লাগে মিনিট কয়েক।
বড় বড় শহরের বাইরের এলাকাগুলোতে যেখানে রেললাইন আছে, সেখানেই চলত তখন নরি। মোটামুটি বড় একটা দূরত্ব বাঁশের এই ট্রেন দিয়েই পাড়ি দেওয়া সম্ভব ছিল। তবে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে নরির সেই রমরমা আর নেই। বিগত বছরগুলোতে কম্বোডিয়ার বেশির ভাগ রেললাইন সংস্কার করা হয়েছে যাত্রীবাহী ও মালগাড়ি চলাচলের জন্য। বিশালাকার ইস্পাতের ট্রেনের পাশাপাশি এই পুঁচকে নরি চলবে কীভাবে বলেন? ক্রমেই চলার এলাকা কমতে কমতে ২০১৭ সালে এসে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় নরির কার্যক্রম।
যারা মনে মনে নরিতে চড়বার জন্য হলেও ভবিষ্যৎ ভ্রমণ পরিকল্পনায় কম্বোডিয়ার নাম রেখেছিলেন তারা আবার এতটুকুন পড়েই হতাশ হবেন না যেন! ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বেটামবাংয়ের ফনম বেনান পর্বতের পাদদেশ থেকে শুধু নরির জন্য একটা লাইন স্থাপন করা হয়েছে। মূল শহর থেকে একটু দূরে নতুন এই নরি পর্যটকদের কথা ভেবেই করা হয়েছে।
এদিকে কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর সীমিত পরিসরে হলেও আবার শুরু হয় পুরোনো নরির চলাচল। বেটামবাং শহরের পাশেই ডামবং এবং ও শ্রা লাভের মাঝখানের এলাকায় চলে পুরোনো এই বাঁশের ট্রেন। তবে পুরোনো নরিতে চড়া পর্যটকদের দাবি, বাঁশের ট্রেনে ভ্রমণের মূল আমেজ পেতে চাইলে পুরোনো বাঁশের ট্রেনই আদর্শ।
সূত্র : বিবিসি, উইকিপিডিয়া, ব্যাকপেকারস ওয়ন্ডারলাস্ট