বিজেপির শাসন টিকিয়ে রাখতেই মণিপুরে প্রেসিডেন্ট শাসন

স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৫, ১০:৫৭

মণিপুরে প্রেসিডেন্ট শাসন জারি। ছবি: সংগৃহীত
ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে সংঘাত বরাবরই দেশটির জন্য মাথাব্যথার কারণ। ২০২৩ সালের মে মাস থেকে মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চলে আসছে মণিপুরে। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, খুন- কিছু বাদ যায়নি উত্তর-পূর্বের রাজ্যটিতে। সবমিলিয়ে ২৫০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এই গোটা সময়ে সেখানে বিজেপির সরকার ছিল। ঘরে-বাইরে চাপের মুখে পড়ে ৯ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। নতুন মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এরপর ১৩ ফেব্রুয়ারি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫৬-এর আওতায় মণিপুরে প্রেসিডেন্ট শাসন জারি করে কেন্দ্র সরকার। এর মধ্য দিয়ে কার্যত বিধানসভায় অনাস্থা ভোট এড়াতে চেয়েছে কেন্দ্র। তবে প্রেসিডেন্ট শাসনেও যে শান্তি অনেক দূরহস্ত, তা বলাই বাহুল্য।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, মণিপুরের রাজ্যপাল প্রেসিডেন্টকে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন, তাতে বোঝা যায়, রাজ্যে এই মুহূর্তে সাংবিধানিক শাসন চালানোর অবস্থা নেই। তাই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫৬-এর আওতায় প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে রাজ্যে প্রেসিডেন্ট শাসন জারি হয়।
এর কয়েক দিন আগে একটি অডিও রেকর্ডিং সামনে আসে। তাতে যে কথোপকথন ধরা পড়ে, তার একটি গলা বীরেনের বলে অভিযোগ। কথোপকথন থেকে জানা যায়, রাজ্য সরকারের অস্ত্রশস্ত্র লুট করতে মেইতেই মিলিশিয়াদের অনুমতি দেওয়া হয়। কুকিদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে এভাবেই অস্ত্রের জোগান দেওয়া হয় মেইতেই মিলিশিয়াদের। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টি পৌঁছেছে। অডিও রেকর্ডিংটির ফরেনসিক পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।
মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ নিয়ে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, প্রায় দুই বছর ধরে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং মণিপুরে বিভাজনে উসকানি দিচ্ছিলেন। সহিংসতা, প্রাণহানি ও মণিপুরে ভারতের যে আদর্শ তা ধ্বংস হলেও (প্রধানমন্ত্রী) নরেন্দ্র মোদি তাকে কাজ চালিয়ে যেতে দিচ্ছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এখন সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হলো, মণিপুরে শান্তি ফিরিয়ে আনা। মণিপুরের ক্ষতে প্রলেপ লাগানো। অথচ এখন পর্যন্ত মণিপুরের অবস্থা দেখতে যাননি মোদি। সেখানকার বিধানসভায় বিজেপির বেশ কয়েকজন এমএলএ দিল্লিতে গিয়ে দলীয় হাই-কমান্ডের সঙ্গে একাধিকবার দেখা করার পরও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শরদ গুপ্ত বলেন, ‘বিজেপির মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন তা নিয়ে প্রবল বিরোধ ছিল। কুকি বিধায়করা মেইতেইদের থেকে কাউকে মুখ্যমন্ত্রী করার প্রবল বিরোধী ছিলেন। মেইতেইদের দাবি ছিল, তাদের মধ্য থেকেই মুখ্যমন্ত্রী করতে হবে। তা ছাড়া মেইতেই নেতারাও কোনো একটি নাম নিয়ে একমত হতে পারেননি।’
দৈনিক ভাস্করের রাজনৈতিক সম্পাদক হেমন্ত অত্রির মতে, ‘২০২৩ সালের মে মাস থেকে মণিপুরে সহিংসতা চলছে। বহু বিধায়ক একাধিকবার দিল্লিতে এসে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সামনে ধারাবাহিকভাবে নিজেদের অসন্তোষের কথা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কোনো সমাধান না হওয়ায় রাজ্য বিজেপির ভেতর ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। বিজেপি ভয় পেয়েছিল যে বীরেন সিংয়ের কারণে আস্থা ভোট পরীক্ষা হলে তাদের অনেক বিধায়কই দলীয় হুইপ অমান্য করতে পারেন। কেন্দ্রে তাদের সরকার থাকাকালে এমন পরিস্থিতি হলে তা দলের পক্ষে অস্বস্তির কারণ হতে পারত।’
দ্য হিন্দুর উপসম্পাদক বিজেতা সিং বলেন, ‘কুকিরা বীরেন সিং এবং তার লোকেদের চায় না। অন্যদিকে মেইতেইরা কোনো কুকি নেতাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। বিজেপির একাধিক কুকি বিধায়কও নির্বাচিত হয়েছেন। দলের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল এমন একজন নেতাকে বেছে নেওয়া, যিনি দুই পক্ষকেই সামলাতে পারবেন। কিন্তু কোনো একক নেতার বিষয়ে সবাই একমত হতে পারেনি।’
৬০ সদস্যের মণিপুর বিধানসভায় বিজেপির ৩৭ জন বিধায়ক আছেন এবং তাদের জোটসঙ্গীদের ১১ জন বিধায়ক রয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই রাজ্যে প্রেসিডেন্ট শাসন জারি করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট শাসন জারির পর মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং রাজ্য সরকারের সব বিষয় প্রেসিডেন্টের কাছে চলে যায়। এই অবস্থায় দুই মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। প্রেসিডেন্ট শাসনের মেয়াদ ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ তিন বছর করা যেতে পারে। বিশেষ পরিস্থিতিতে এর সময়সীমা তার বেশিও হতে পারে।
প্রসঙ্গত, গত বছর মণিপুরের বিজেপি সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেয় কনরাড সাংমার ন্যাশনাল পিপলস পার্টি। এতে চাপে পড়েন বীরেন সিং। পরে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে সাক্ষাতের পরই বীরেন পদত্যাগ করেন। এতে স্পষ্ট যে, দিল্লির বিজেপি নেতৃত্বের জন্যই জাতিগত সংঘাতে সরাসরি মদদ দেওয়ার অভিযোগের পরও বীরেন এতদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পেরেছিলেন। আর দিল্লির নির্দেশেই তিনি পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ না করলে ১০ ফেব্রুয়ারি বীরেন সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে যাচ্ছিল বিরোধীরা, তাতে হেরে গেলে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ হাতের বাইরে চলে যেত।