রুশ আগ্রাসনের ৩ বছর
ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান হচ্ছে তো

অরুন্ধতী সুরঞ্জনা
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৫, ১০:৩৯

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের তিন বছর পূর্ণ হয়ে গেল। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার সেনাবাহিনীকে ইউক্রেনে সর্বাত্মক সামরিক আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই তিন বছরে দুই দেশেরই বহু মানুষের প্রাণ ঝরেছে। সেনা সদস্য ছাড়াও বেসামরিক মানুষ হতাহতের শিকার হয়েছে। বিশেষ করে ইউক্রেনের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক হারে।
সামরিক শক্তিতে অনেক পিছিয়ে থাকলেও তিন বছর প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে ইউক্রেন। এমনকি কয়েক মাস আগে রাশিয়ার ভেতরে ঢুকে কুরস্ক অঞ্চলে আক্রমণ করে ইউক্রেনীয় বাহিনী। এই শক্তি দেশটি পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দিয়ে এই যুদ্ধকে প্রলম্বিত করেছেন বলে খোদ তার উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন। তিনি ক্ষমতায় এসেই এই যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছেন। ক্ষমতায় ফিরলেই ২৪ ঘণ্টায় যুদ্ধ থামিয়ে দেবেন, এই বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, একে শুধু ২৪ ঘণ্টার ফ্রেমে না বাঁধলে বলা যায়, ট্রাম্প এই যুদ্ধ বন্ধে প্রকৃত অর্থেই মনোযোগ দিয়েছেন। এমনকি যুদ্ধ চলতি সপ্তাহেই বন্ধ হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লেভিট।
সাংবাদিকদের লেভিট বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার দল এই যুদ্ধের উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার দিকে অত্যন্ত মনোযোগী। কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল অ্যাকশন কনফারেন্স (সিপিএসি) থেকে ফিরে এসে আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই সপ্তাহের মধ্যেই সমাধান করতে পারব।’ কিন্তু ট্রাম্পের এই যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগে নাখোশ হয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি গত তিন বছরে এক রকম ‘প্রতিরোধ যুদ্ধের নায়ক’ হয়ে ছিলেন। তবে ট্রাম্প এসে দেখিয়ে দিয়েছেন, তিনি রীতিমতো একজন অবৈধ প্রেসিডেন্ট, কারণ তার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে। এই কারণে সৌদি আরবে রুশ-মার্কিন শান্তি আলোচনায় খোদ জেলেনস্কি কিংবা তার কোনো প্রতিনিধি আমন্ত্রণ পাননি। একে বাঁকা চোখে দেখছে ইউরোপ। মহাদেশটির নেতারা কিয়েভে গেছেন জেলেনস্কির পাশে দাঁড়াতে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে।
ট্রাম্পের ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের প্রচেষ্টাকে নেতিবাচকভাবে দেখছেন ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতারা। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। এই অবস্থায় ইউক্রেনকে ভরসা দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা কিয়েভে গিয়ে বৈঠক করেছেন। তবে ট্রাম্প খুব কড়া সুরে বলেছেন, তিনি ইউক্রেনের সঙ্গে ‘একটি চুক্তির খুব কাছাকাছি’ আছেন। তিনি স্পষ্ট করেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধে ওয়াশিংটন যে সাহায্য দিয়েছে, তা পুনরুদ্ধার করাই তার উদ্দেশ্য। ২২ ফেব্রুয়ারি ম্যারিল্যান্ডের অক্সন হিলে ট্রাম্প কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল অ্যাকশন কনফারেন্সেই এই অবস্থান ব্যক্ত করেন।
ট্রাম্প বলেন, ‘ইউরোপ ইউক্রেনকে ১০০ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার, কারণ আমাদের এক নির্বোধ, অদক্ষ প্রেসিডেন্ট ও অকেজো প্রশাসন ছিল। আমি চাই ইউক্রেন আমাদের কিছু দিক, সেই বিপুল অর্থের বিনিময়ে যা আমরা তাদের দিয়েছি। তাই আমরা বিরল খনিজ ও তেল চাচ্ছি। অথবা তারা আমাদের এমন কিছু দিক যা আমরা পেতে চাই।’
এদিকে রুশ সেনাবাহিনীকে আরো শক্তিশালী করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ক্রেমলিন থেকে প্রকাশিত ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, তারা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে মাতৃভূমি, জাতীয় স্বার্থ এবং রাশিয়ার ভবিষ্যৎ রক্ষায় লড়াই করছে। রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী ও উন্নত করার কৌশল অপরিবর্তিত থাকবে।
অন্যদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, তার দেশের শান্তির জন্য তিনি প্রয়োজনে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দিতে রাজি আছেন। ইউক্রেন যদি ন্যাটোর সদস্য পদ পাওয়ার সত্যিকার স্বীকৃতি পায়, তা হলে তিনি ক্ষমতা ছাড়তেও রাজি আছেন। তিনি রাশিয়ার আক্রমণের জবাবে ইউক্রেনের ‘প্রতিরোধ’ ও ‘বীরত্বের’ প্রশংসা করেছেন।
ট্রাম্প জেলেনস্কিকে একজন ‘স্বৈরশাসক’ আখ্যায়িত করার পর কিয়েভের অনেক সমীকরণ বদলে যাচ্ছে। কিয়েভে সংবাদ সম্মেলনে জেলেনস্কি বলেছেন, ‘আপনারা যদি আমাকে এই চেয়ার থেকে সরে যেতে বলেন, তা করতে আমি প্রস্তুত রয়েছি। আর ন্যাটোয় ইউক্রেনের সদস্য পদের বিনিময়েও আমি তা করতে পারি।’ ট্রাম্পের মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি বিরক্ত হইনি, তবে একজন স্বৈরাচারী শাসক নিশ্চয়ই বিরক্ত হতেন।’
ট্রাম্পের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে জেলেনস্কি বলেন, তিনি ট্রাম্পকে ইউক্রেনের একজন অংশীদার হিসেবে দেখতে চান। তিনি চান কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যে একজন মধ্যস্থতাকারীর চেয়ে বড় ভূমিকা রাখুক মার্কিন প্রেসিডেন্ট। জেলেনস্কি বলেন, ‘আমি আসলেই চাই, এটা মধ্যস্থতার চেয়ে বেশি কিছু হোক... এটি যথেষ্ট নয়।’ ২০১৯ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হন জেলেনস্কি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার অভিযান শুরুর পর ইউক্রেনে সামরিক শাসন জারি করা হয়; বাতিল করা হয় নির্বাচন। জেলেনস্কি বলেন, বর্তমানে তিনি ইউক্রেনের নিরাপত্তার দিকে নজর দিচ্ছেন। এক দশক ধরে প্রেসিডেন্ট থাকা তার ‘স্বপ্ন’ নয়। এখন দেখার বিষয়, যুদ্ধের জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।