Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

মহাকুম্ভে মহাদূষণ

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২৫, ১০:০৪

মহাকুম্ভে মহাদূষণ

কুম্ভমেলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৬ কোটি মানুষ সঙ্গমে স্নান করেছে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী- তিন নদীর সঙ্গমস্থল ত্রিবেণী বরাবরই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচ্য। এই তিন নদীই কারখানা ও মানবসৃষ্ট দূষণে আক্রান্ত। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজে সঙ্গমস্থল থেকে পানির নমুনা পরীক্ষা করে দেশটির কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ যে প্রতিবেদন পরিবেশ আদালতে জমা দিয়েছে, সেখানে দেখা গেছে- এই পানি মানুষের স্নানের যোগ্য নয়। অথচ এ নিয়ে উত্তর প্রদেশ সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য একদমই ভিন্ন। তারা ওই প্রতিবেদন উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, এই দূষিত পানি নাকি পানেরও যোগ্য!

বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত বর্জ্য প্রতিদিন এসে মিশছে গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী নদীতে। গত নভেম্বর মাসেই জাতীয় পরিবেশ আদালত জানিয়েছিল, উত্তর প্রদেশ সরকারের তথ্য অনুসারে, সে রাজ্যে উৎপাদিত বর্জ্য এবং পরিশোধিত বর্জ্যরে পার্থক্য প্রায় ১২ কোটি লিটারেরও বেশি। অর্থাৎ ওই পরিমাণ অপরিশোধিত মানববর্জ্য প্রতিদিন এসে মিশছে নদীতে। নভেম্বর মাসেই প্রয়াগরাজে কোলিফর্ম ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতি ছিল নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, ২৫০টির বেশি নালা থেকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বর্জ্য এসে মিশছে গঙ্গা ও তার শাখা নদীগুলোতে। মহাকুম্ভের মতো এক বিশাল জনসমাগমের জন্য উত্তর প্রদেশ সরকার হিন্দুত্ববাদী প্রচার ও জাঁকজমকপূর্ণ সজ্জা চালিয়ে গেলেও বর্জ্য পরিশোধন এবং নদীর পানির মান উত্তরণের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ক কোনো তথ্যই রাজ্য বা কেন্দ্রের কোনো সংস্থার ওয়েবসাইটে নেই। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে লৌকিক হিত-অহিত বিচারের ক্ষমতা মানুষের রয়েছে। তাই এসব তথ্য জনসমক্ষে না এনে অলৌকিক লাভকে প্রধান করে দেখাচ্ছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতারা। 

কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সঙ্গমস্থলের পানিতে ই-কোলাই, সালমোনেলাসহ নানা ধরনের আন্ত্রিক রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে; আর তা নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বহুগুণ বেশি। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, গঙ্গায় কলিফর্মের (এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া) মাত্রা গ্রহণযোগ্য সীমার চেয়ে এক হাজার ৪০০ গুণ বেশি এবং যমুনায় ৬৬০ গুণ বেশি।

এর আগেও উত্তর প্রদেশ সরকার কুম্ভমেলা আয়োজন ও পরিচালনার জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছিল। গত জানুয়ারি মাসে সঙ্গমের কাছে স্নান করতে এসে পদপিষ্ট হয়ে অন্তত ৩০ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া এ মাসে দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে ভক্তদের ভিড়ে পদপিষ্ট হয়ে ১৮ জনের মৃত্যু হয়। এই প্রতিবেদন পুণ্যার্থীদের মনে দ্বিধা ও ভীতি তৈরি করলেও ভিড় কমেনি। লৌকিক অবস্থা যখন মানুষ নিজে বদলানোর ক্ষমতা না রাখে; তখন অলৌকিকতাই হয়ে পড়ে একমাত্র ভরসার স্থল। আর এই কারণে রোগ, অসুখ, সংক্রমণের চিন্তা এড়িয়ে কোটি কোটি মানুষ জড়ো হয়েছে ত্রিবেণী সঙ্গমস্থলে। পাপ মোচনের আশায় কয়েক কোটি মানুষ নদীতে স্নান করেছেন। এ নিয়ে শোরগোল শুরু হতেই যোগী আদিত্যনাথ সরকারের কর্মকর্তারা প্রচার শুরু করেছেন, তারা কত লাখ অস্থায়ী শৌচাগার তৈরি করেছেন, কত হাজার টন ব্লিচিং পাউডার, ফিনাইল, ন্যাপথলিন বিতরণ করেছেন, মানববর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের কত আধুনিক ব্যবস্থা করেছেন। অথচ এসবই মানুষের চোখে ধোঁকা দেওয়ার একেকটি উদাহরণ। কারণ দূষণ শুধু কুম্ভমেলা থেকে হচ্ছে না। এই দূষণের ঘটনা অনেক পুরোনো। 

বহু মানুষের জীবন সংকট থাকলেও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের দাবি, ‘এই জল শুধু স্নানের জন্যই নয়, আচমন করার (হিন্দুধর্মীয় রীতি অনুযায়ী স্নানের পর এক চুমুক জল পান করা) জন্যও সম্পূর্ণ নিরাপদ। সরকার নদীর জলের গুণমান বজায় রাখতে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছে। কলিফর্মের মাত্রা বৃদ্ধির পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। যেমন- স্যুয়ারেজ লিকেজ বা পশুর বর্জ্য। কিন্তু প্রয়াগরাজে কলিফর্মের মাত্রা ঠিক আছে।’ তিনি বিষয়টিকে কুম্ভমেলার সুনাম নষ্ট করার জন্য বিরোধী দলগুলোর ‘মিথ্যা প্রচারণা’ বলে অভিযোগ করেন। ১৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া কুম্ভমেলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৬ কোটি মানুষ সঙ্গমে স্নান করেছে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ত্রিবেণী সঙ্গমে ফটোসেশন করেছেন। তবে তিনি বা যোগী আদিত্যনাথকে সেই দূষিত পানি পান করতে দেখা যায়নি। এ নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি বলিউডের জনপ্রিয় সংগীত ব্যক্তিত্ব বিশাল দাদলানি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ‘স্যার, নিন্দুকদের নিয়ে এত মাথাব্যথার কিছু নেই। আমরা আপনার কথা বিশ্বাস করি। দয়া করে আপনি চালিয়ে যান। আর ক্যামেরার সামনে একটা বড় ঢোকে মহাকুম্ভের পানি পান করে দেখিয়ে দিন। আমাশয়, কলেরা, কৃমি- এসব কিছুর আশঙ্কা যদি আপনার না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে আপনি বিশেষ ক্ষমতাবান। দয়া করে আপনি ও আপনার পরিবার এই নর্দমায় ডুব দিয়ে দিন। ঈশ্বর আপনাকে আরো শক্তি দিন।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫