ট্রাম্পের নতুন অধ্যায়ে ইউরোপের ভবিষ্যৎ কতটা নিরাপদ

নাজমুস সাকিব
প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৫, ০৯:৪৫

ট্রাম্প-জেলেনস্কির বাগবিতণ্ডা। ছবি: সংগৃহীত
জার্মানির মিউনিখে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের মোড়ল দেশগুলোর অংশগ্রহণে (চীন ও রাশিয়া বাদে) ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হলো ৬১তম মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন (এমএসসি)। এবার এই সম্মেলন শুধু একটি আলোচনার মঞ্চ ছিল না, বরং বৈশ্বিক রাজনীতির সংকট ও উত্তরণের চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি করে। সম্মেলনে দেওয়া বিশ্বনেতাদের বক্তব্য, প্রতিক্রিয়া এবং নীতিগত ঘোষণা ভূ-রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের দিকে ইঙ্গিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের যুগের অবসান, চীনের উত্থান, ইউরোপের স্বাধীনচেতা নীতির সন্ধান এবং রাশিয়ার ভূমিকা- এসব প্রশ্ন এবার মিউনিখের মঞ্চে নতুন মাত্রা পেয়েছে।
এবারের সম্মেলনে ইউরোপীয় নেতাদের পাশাপাশি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শুলৎজ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্ক রুবিও অংশ নেন। এমএসসির এবারের সম্মেলন ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বদলের কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বেশ আগে থেকেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্পের বক্তব্যে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে ইউক্রেনকে দেওয়া সামরিক সহায়তা বন্ধ, যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেনকে ছাড়াই সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় পুতিনের সঙ্গে আলোচনা, ইউক্রেনে খনি ভাগাভাগির প্রস্তাব, ন্যাটোর ব্যয়ে ইউরোপের অংশীদারি বাড়ানোসহ নানা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের তিক্ততা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এই সম্মেলন ভিন্নমাত্রা লাভ করে। তিন দিনের আলোচনায় এসব জটিল পরিস্থিতির যে সমাধান মেলেনি, তা স্পষ্ট হয়ে যায় এমএসসির বিদায়ি চেয়ারম্যান ক্রিস্টোফ হিউসগেনের অশ্রুসজল বক্তব্যে।
সমাপনী বক্তব্য তিনি ইউরোপের সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্কচ্ছেদ ও ট্রান্স আটলান্টিক অনৈক্যের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। হিউসগেন তার বক্তব্যে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের বক্তব্য শোনার পর আশঙ্কা করতে হবে যে আমাদের সাধারণ মূল্যবোধ আর ততটা সাধারণ নেই।’ এই মন্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঐতিহ্যগত কূটনৈতিক ঐক্য শঙ্কায় পড়েছে। এই পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ইউরোপের ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন বলে আখ্যায়িত করছেন। বলা হচ্ছে, আয়রন কার্টেন পতনের পর থেকে ইউরোপের এত দুঃসময় আর দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন, নিরাপত্তা সংকট এবং আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন ইউরোপের স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
বিষয়টি শুধু ইউক্রেনের পরাজয়ের মধ্যে নেই। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনের দখলকৃত ভূখণ্ড রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হলে এবং জেলেনস্কিকে সরিয়ে নতুন কেউ দায়িত্ব নিলে ভয়ংকর নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে সমগ্র ইউরোপ। এরই মধ্যে জেলেনস্কিকে অবৈধ (যেহেতু তার মেয়াদ শেষ) ও স্বৈরাচার আখ্যা দিয়ে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন ট্রাম্প। জেলেনস্কির স্থলাভিষিক্ত যেই হোক সে যে রাশিয়ার আজ্ঞাবহ ব্যক্তি হবেন তা সহজেই অনুমিত। যুক্তরাষ্ট্র এখন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইছে। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় শক্তিগুলো নিজেদের মতো করে এগিয়ে গেলে ওয়াশিংটনের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ‘রাশিয়াকে অব্যাহতভাবে বিচ্ছিন্ন’ রাখতে গিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেরাই কোণঠাসা হয়ে পড়বে। এটা করতে গিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো কার্যত ‘নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে’।
ইউরোপ এর আগেও নানা সংকটের সম্মুখীন হয়েছে- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ঠান্ডা যুদ্ধ, অভিবাসন সংকট কিংবা ব্রেক্সিট। কিন্তু বর্তমান সংকট ভিন্ন, কারণ এটি একযোগে অনেক বিষয়কে প্রভাবিত করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তা ঝুঁকি, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং সামাজিক বিভাজন সবকিছুই ইউরোপকে নতুন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এখন প্রশ্ন উঠছে- ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নৈতিকতা ও মূল্যবোধের কী হবে? মানবাধিকার, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র- এই মূল্যবোধগুলোকে ইউরোপীয় দেশগুলো সব সময় গর্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে। কিন্তু যখন ইউক্রেনের মতো একটি দেশ কঠিন সময় পার করছে, তখন ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ। ইউরোপীয় মূল্যবোধের কথা বলা হলেও বাস্তবতা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে তা বারবার আপস করতে হচ্ছে। ইউক্রেন সংকটের সমাধানে যদি নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া হয়, তবে ইউরোপের ভবিষ্যৎ আদৌ কতটা নিরাপদ থাকবে? এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ ও পাবলিক পলিসি এনালিস্ট জেফ্রি স্যাচ ইউরোপীয় কমিশনে দেওয়া বক্তব্যে ইউরোপের নিজস্ব নীতি না থাকাকে দুষছেন। বিশেষ করে ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ইউরোপ স্বকীয় নীতি প্রণয়নে ব্যর্থ হয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতেই সম্মত থেকে তাদের প্রতি অন্ধ সমর্থন দিয়েছে। ফলে বর্তমানে অনেকটা অসহায় পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে ইউরোপকে।