
জেলেনস্কি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এমন বিপাকে আগে পড়েনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। এতদিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে এসেছেন তিনি। হঠাৎ করে সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগমনে। এ বছরের ২০ জানুয়ারি ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের মসনদে বসেই তার পূর্বসূরি জো বাইডেনের নেওয়া প্রায় সব নীতি ও সিদ্ধান্ত বাতিলের খাতায় ফেলে দেন।
জেলেনস্কির ক্ষীণ আশা ছিল হয়তো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ইস্যুতে ইউরোপের মতোই সমর্থন বজায় রাখবে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ ট্রাম্পের জানুয়ারিতে শপথ গ্রহণের আগে যুক্তরাষ্ট্র ছিল ইউক্রেনের প্রধান মিত্র। জেলেনস্কি তাই নিজেই যেচে দেখা করেন ট্রাম্পের সঙ্গে। কিন্তু দেখা গেল ইউক্রেন নীতিতে পরিবর্তন এনে যুদ্ধ দ্রুত শেষ করতে আগ্রহী ট্রাম্প। বৈঠকে জেলেনস্কিকে রীতিমতো বেইজ্জতি হতে হয় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের হাতে। ট্রাম্প এতটাই রেগে যান তিনি কূটনীতিক শিষ্টাচার অতিক্রম করে জেলেনস্কির সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। বৈঠকের সময় ট্রাম্প জেলেনস্কিকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে ‘জুয়া খেলার’ অভিযোগ করেন এবং বলেন, ‘আপনার দেশের মানুষ খুবই সাহসী, কিন্তু আপনাকে হয় (রাশিয়ার সঙ্গে) একটি চুক্তি করতে হবে, নইলে আমরা আর আপনাদের সঙ্গে নেই।’
এই ঘটনার পর আর বসেননি জেলেনস্কি, রাষ্ট্রীয় ভোজে অংশ না নিয়ে সোজা চলে যান যুক্তরাজ্যে। সেখানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারের সঙ্গে দেখা করলে তিনি ইউক্রেনের প্রতি তার দেশের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। বলা বাহুল্য, যা ছিল ইউরোপের অন্য দেশগুলোর সমর্থনের প্রতিধ্বনি। জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের এমন ব্যবহার সহজ চোখে দেখছে না ইউরোপ। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক এবং স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজও ইউক্রেনের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ জেলেনস্কির এই পরিস্থিতিকে ‘উপযুক্ত থাপ্পড়’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এদিকে এই ঘটনার পর সরাসরি মস্কোর সঙ্গে আলোচনা করেন ট্রাম্প। তিনি কিয়েভকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দেন এবং ইউক্রেনের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান স্থগিত করেন। বলা বাহুল্য, ২০২২ সালে রুশ বাহিনী ব্যাপকভাবে ইউক্রেন আক্রমণ করার পর যুক্তরাষ্ট্র এই সহায়তা প্রদান করেছিল। বোঝাই যাচ্ছে, ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যে নাটকীয় দ্বন্দ্বে দুই দেশের সম্পর্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ফলে ইউক্রেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ চুক্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, যে চুক্তিকে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সমর্থনের মূল শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এতসব ঘটনার পরও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন লাভ ও ট্রাম্পের মন গলাতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন জেলেনস্কি। ট্রাম্পের প্রবল চাপে, জেলেনস্কি এখন দেখানোর চেষ্টা করছেন যে তার দেশ যুদ্ধের অবসানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সম্প্রতি এক টেলিগ্রাম বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব এবং সমগ্র ইউরোপের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তি অর্জন সম্ভব। তিনি ইউরোপীয় দেশগুলোর সামরিক সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এবং এই সহায়তা ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে মন্তব্য করেছেন।
তবে ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বেশ জটিল। জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার পরও তার অভ্যন্তরীণ মহল, বিশেষ করে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট প্রশাসনের প্রধান আন্দ্রে ইয়েরমাক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে। যুদ্ধের সময় করা জরিপে বিশ্বাস করা কঠিন, ফলে ইউক্রেনীয় জনগণ সত্যিই জেলেনস্কির পদত্যাগ চায় কি না, তা বোঝা সহজ নয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাশিয়ার আক্রমণের অবসানের জন্য কিয়েভকে আলোচনায় বাধ্য করার প্রচেষ্টা চলছে। ট্রাম্প ইউক্রেনকে সামরিক গোয়েন্দা তথ্য ও স্যাটেলাইট তথ্য ভাগাভাগি বন্ধ করেছে এবং দেশটির প্রতি কিছু সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে। এটি ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলে আনতে একটি কৌশল হতে পারে। এতকিছুর মধ্যেও কিন্তু রাশিয়ার সামরিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণ চালাচ্ছে, যা যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। এই পরিস্থিতিতে জেলেনস্কি সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এর ধারাবাহিকতায় ১০ মার্চ সৌদি আরব সফর করেন জেলেনস্কি। যেখানে তিনি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এই সাক্ষাতের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন বৃদ্ধি করা। জেলেনস্কির আশাÑআন্তর্জাতিক সমর্থন ও অব্যাহত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এই সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু বিশ্ব মোড়ল তথা যুক্তরাষ্ট্রের মসনদে যখন ট্রাম্প আসীন, তবে এত সহজেই কী মিলবে সমাধান? এর উত্তর লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের গর্ভে।