
পানামা খাল। ছবি: সংগৃহীত
উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশকে আলাদা করা এবং আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে যুক্ত করা পানামা খাল বিশ্ববাণিজ্যে ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। ৮২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাল দিয়ে সমুদ্রপথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৬ শতাংশ পরিচালিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব থেকে পশ্চিম উপকূল অভিমুখে যাত্রাকারী সব জাহাজকে দক্ষিণ আমেরিকার কেপ হর্ন হয়ে ঘুরে যাওয়ার মাধ্যমে অতিরিক্ত ১৫ হাজার কিলোমিটার (আট হাজার নটিক্যাল মাইল) পথ অতিক্রম করার ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়েছে পানামা খাল। এ ছাড়া উত্তর আমেরিকার এক দিকের উপকূল থেকে দক্ষিণ আমেরিকার অন্য দিকের উপকূলে যাওয়ার ক্ষেত্রেও পানামা খাল সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটার পথ কমিয়ে দিয়েছে। এই পথের কারণে ইউরোপ এবং পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে যাতায়াতকারী জাহাজেরও প্রায় তিন হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরত্ব কমেছে।
প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ শতাংশ কনটেইনার পরিবহন করা হয় পানামা খাল ব্যবহার করে। এক হিসাবে ২০২১ সালে এই খাল দিয়ে পার হওয়া মোট জাহাজের ৭৩ শতাংশের বেশি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বন্দরের দিকে যায় বা সেখান থেকে আসে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই খালটির এককভাবে সবচেয়ে ব্যবহারকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। এই খালের দ্বিতীয় বৃহৎ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারকারী চীন। ১৯১৪ সালের ১৫ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার শুরুর পর থেকে দীর্ঘদিন খালটির নিয়ন্ত্রণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। এ নিয়ে নানা পক্ষে বিরোধ চলে আসছিল। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার স্বাক্ষরিত এক চুক্তির আওতায় ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র খালটির মালিকানা পানামার কাছে হস্তান্তর করে। টোরিজোস-কার্টার চুক্তির আলোকে খালটি পরিচালনা করে আসছে পানামা। এই পথ ব্যবহারকারীদের শুল্ক পানামার জিডিপি বৃদ্ধিতে বিশাল ভূমিকা রাখে।
ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেসব ‘উচ্চাভিলাষী’ (আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও রীতিনীতির বিবেচনায় চরম বিতর্কিত) ঘোষণা দিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম কানাডার যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য বানানো, গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ, গালফ অব মেক্সিকোর নাম পরিবর্তন এবং পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ। ঘোষণার পর থেকেই পানামা প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। তবে থেমে নেই ট্রাম্পের উদ্যোগ। অবকাঠামোসহ নানা বিষয়ে চীনের সঙ্গে পানামার মাখামাখি, বিশেষ করে ২০২৩ সালে পানামার সঙ্গে চীন নতুন করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের আলোচনা শুরুর পর থেকে দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উষ্ণ সম্পর্ক শীতল হতে শুরু করে। এসব অভিযোগের পাশাপাশি বাড়তি শুল্ক আদায়ের অভিযোগ তুলে পানামা খাল পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ব্যাপারে অনড় থাকে যুক্তরাষ্ট্র। সবশেষ মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ সংস্থা পানামা খালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বন্দর কেনার ঘোষণা দিয়েছে।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, হংকংভিত্তিক কোম্পানি সিকে হাচিসন ২২.৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে বন্দর দুটির বেশির ভাগ মালিকানা ব্ল্যাকরকের কাছে বিক্রি করতে রাজি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, হংকংভিত্তিক সিকে হাচিসন তাদের ব্যবসা ব্ল্যাকরক, গ্লোবাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার পার্টনার্স (জিআইপি) ও টার্মিনাল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের একটি কনসোর্টিয়ামের কাছে বিক্রি করছে। কোম্পানির বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, এই গোষ্ঠী পানামায় দুটি বন্দরের মালিকানা ও পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের ৯০ শতাংশ শেয়ার অধিগ্রহণ করবে।
সমুদ্র বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পথের এই অধিগ্রহণকে যুক্তরাষ্ট্রের বিজয় হিসেবে দেখছেন ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের আমেরিকাস প্রোগ্রামের পরিচালক রায়ান বার্গ। তার মতে, এর মধ্য দিয়ে খালের নিরাপত্তা নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটাবে। তিনি বলেন, আমেরিকা মহাদেশে চীনের সঙ্গে কৌশলগত প্রতিযোগিতায় এটি যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বিজয়। একই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জেপি মর্গানও। তারা এই বিক্রিকে ‘অপ্রত্যাশিত’ ও ‘সুযোগসন্ধানী’ বলে অভিহিত করেছেন।
এই ঘটনার পর ট্রাম্প পানামা খাল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কাজ শুরু করেছি বলে মন্তব্য করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে প্রেসিডেন্টের ভাষণে ট্রাম্প ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা আরো শক্তিশালী করতে ওয়াশিংটন পুনরায় পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেবে। আমরা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছি। এটি পুনরুদ্ধার করছি। তার বক্তব্যের প্রতিবাদে পানামার প্রেসিডেন্ট জোসে রাউল মুলিনো বলেন, ট্রাম্প মিথ্যাচার করছেন।
পানামা খালের বর্তমান পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান সিকে হাচিসন যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ বিশ্বের ২৩টি দেশের ৪৩টি বন্দর পরিচালনা করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, মেক্সিকো ও অস্ট্রেলিয়াও তারা বন্দর পরিচালনা করে। নতুন এই চুক্তির ফলে শুধু পানামা খালের বন্দর নয়, সিকে হাচিসনের বৈশ্বিক বন্দর কার্যক্রমের বড় অংশ ব্ল্যাকরক ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানায় চলে যাচ্ছে।