ইয়েমেন সংঘাত
ট্রাম্প কি পারবেন হুতিদের হারাতে

অরুন্ধতী সুরঞ্জনা
প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ১০:২৮

ইয়েমেনে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র।
ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালিয়ে ৫০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। সাম্প্রতিক এই হামলার জবাবে পালটা হামলা চালিয়েছে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। তাদের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএস হ্যারি এস ট্রুম্যান বিমানবাহী রণতরি পিছু হটেছে বলে দাবি করেছেন সশস্ত্র গোষ্ঠীটির মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারে। ১৫ মার্চ রাতে ইয়েমেনে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ইউএসএস হ্যারি এস ট্রুম্যান থেকেই বেশ কয়েকটি শহর লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। এতে নারী-শিশুসহ অন্তত ৫৩ জন নিহত হয়।
এক সংবাদ সম্মেলনে সারে জানিয়েছেন, পালটা হামলায় ট্রুম্যান যুদ্ধজাহাজটিকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় ১৮টি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন। হামলার মুখে জাহাজটি ইয়েমেনের জলসীমা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। এদিকে ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে মার্কিন অভিযান অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সেনাবাহিনী সামাজিক মাধ্যম এক্সে হামলার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। যার ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘ইরান সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হুতিদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে সেন্টকম সেনারা।’ এক মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হুতিদের বিরুদ্ধে মার্কিন অভিযান দীর্ঘদিন চলবে। প্রয়োজনে মাসব্যাপী অব্যাহত থাকবে অভিযান।
হুতি বিদ্রোহীদের দ্বারা পরিচালিত সংবাদমাধ্যম আল মাসাইরাহ জানিয়েছে, ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ আল জওফে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা। মাসাইরাহর তথ্য অনুযায়ী, আল হাজম শহরে সরকারি ভবনে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইয়েমেনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সাবা বলছে, হুতিদের কাছে জব্দ থাকা ইসরায়েলি জাহাজ গ্যালাক্সি লিডারের কমান্ড পোস্টকে টার্গেট করেই চালানো হচ্ছে বেশির ভাগ হামলা। এখন পর্যন্ত কমান্ড পোস্টটিকে লক্ষ্য করে দুই দফা হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩ সালের নভেম্বরে লোহিত সাগর থেকে ২৫ জন ক্রুসহ জাহাজটি হাইজ্যাক করে হুতি বিদ্রোহীরা। হুতিদের কাছে দীর্ঘ ৪৩০ দিন জিম্মি ছিলেন ক্রুরা। ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর তাদের মুক্তি দেয় হুতি বিদ্রোহীরা। কিন্তু জাহাজটি হোদেইদা বন্দরেই রয়ে গেছে।
হুতি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। তারা ইয়েমেনের রাজধানী সানাসহ দেশটির বেশির ভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। গোষ্ঠীটির আবির্ভাব ঘটে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। তবে তারা প্রথমবারের মতো দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনায় আসে ২০১৪ সালে। সে সময় তারা ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখল করে। দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবদরাব্বু মনসুর হাদিকে তারা ইয়েমেন ছেড়ে পালাতে বাধ্য করে। ২০১৫ সালের মার্চে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ করে। এই অভিযানে সৌদিকে সমর্থন দেয় পশ্চিমারা। সামরিক জোট ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিমান ও স্থল হামলা শুরু করে। তবে তারা শেষ পর্যন্ত ইরান-সমর্থিত হুতিদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়।
জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের এপ্রিলে ইয়েমেনে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। ইয়েমেন ও সৌদি আরব এখন শান্তি আলোচনায় রয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বেশ সরব প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে হুতিরা। গাজায় সর্বশেষ যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শেষ হয় ১ মার্চ। প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতিকালে ইসরায়েলে-ফিলিস্তিনি পক্ষের মধ্যে জিম্মি ও বন্দিবিনিময় হয়। গাজায় থাকা বাকি ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দিতে হামাসকে বাধ্য করতে সম্প্রতি উপত্যকায় সব ধরনের ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। ত্রাণের পর তারা গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ করে। অন্তত তিন সপ্তাহ ধরে গাজায় এই অবরোধ চলছে।
এমন প্রেক্ষাপটে লোহিত সাগরে ইসরায়েলসংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে আবার হামলার হুমকি দেয় হুতিরা। এই হুমকির পর এখন হুতিদের বিরুদ্ধে বড় পরিসরে সামরিক অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। পালটা হামলা শুরু করেছে হুতিরাও। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ মাসে হুতি বিদ্রোহীরা তিন শতাধিক বাণিজ্য জাহাজে হামলা চালায়। হুতিদের হামলা শুরু হওয়ার আগে লোহিত সাগর দিয়ে বছরে ২৫ হাজারের বেশি জাহাজ যাতায়াত করত। হামলা শুরুর পর এই পথে জাহাজ চলাচল করে মাত্র ১০ হাজার বা তারও কম। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ৭৫ শতাংশ জাহাজই এখন এই পথ এড়িয়ে চলে। বিকল্প পথে গন্তব্যে পৌঁছাতে জাহাজগুলোকে আফ্রিকা ঘুরে যেতে হয়, যে কারণে আগের তুলনায় ১০ দিন বেশি যাত্রা করতে হয় জাহাজগুলোকে। প্রতি ট্রিপে অতিরিক্ত ১০ লাখ ডলার খরচ বেড়েছে।