বেলুচিস্তান রক্ত দিয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। ছবি: সংগৃহীত
বেলুচিস্তান বরাবরই রক্ত দিয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। আলেকজান্ডার ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এ অঞ্চল জয় করেন। এর পরবর্তী বহু শতক ধরে বেলুচিস্তান পারস্য সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের শাসকরা এ অঞ্চল দখল করেন। সপ্তম শতকে আরবরাও অঞ্চলটি দখল করেছিল। এরপর গজনবি, গোরি ও মোঙ্গলরা অঞ্চলটি শাসন করে। সতেরোশ শতকে কিছু সময়ের জন্য এলাকাটি মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। পরে আবার এটি পারস্যের অধীনে আসে। তবে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অধীনে গেলেও এটি নিরঙ্কুশভাবে কেউ নিজের করে নিতে পারেনি। যে কারণে স্বকীয়তা হারায়নি বেলুচিস্তান। ১৮৩৮ থেকে ১৮৪২ সালের প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা অঞ্চলটি দখলে নিয়ে নেয়। ১৮৪১ সালে তারা সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর ১৮৫৪ ও ১৮৭৬ সালে চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের অধীনে আসে বেলুচিস্তান। তবে এর শাসন কাঠামো ছিল স্থানীয় খানদের অধীনে।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় এটি ছিল স্বশাসিত এলাকা বা প্রিন্সলি স্টেট। পাকিস্তানের স্থপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহও প্রথমদিকে বেলুচিস্তানের স্বাধীন অবস্থানের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু পরে ভারত হায়দরাবাদ দখলে নেওয়ার পর রাজনৈতিক চাপের কারণে মত পরিবর্তন করেন এবং পাকিস্তান বেলুচিস্তান দখল করে নেয়। তখন থেকেই চলছে ক্ষোভের আগুন। কারণ স্বাধীনচেতা বালুচ জাতি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সাংস্কৃতিকভাবে লাহোর থেকে ছিল ভিন্ন। এ আন্দোলনের শুরু ১৯৪৮ সালে। তারা পাকিস্তানের ধর্মের ভিত্তিতে চাপিয়ে দেওয়া জাতীয়তাবাদ প্রথম থেকেই নাকচ করে। সাম্প্রতিক বেলুচিস্তানে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ স্বাধীনতাকামী সংগঠন ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যকার সহিংসতা এরই ধারাবাহিকতা।
১১ মার্চ বেলুচিস্তানের বোলানে জাফর এক্সপ্রেস ট্রেন অপহরণ করেছিল বিএলএ। দীর্ঘ অভিযানের পর পাকিস্তানি সেনার তরফে দাবি করা হয় ৩৩ বিদ্রোহীর সবাইকে হত্যা করে অপহৃতদের উদ্ধার করা হয়েছে। তবে পালটা বিদ্রোহীদের তরফে জানানো হয়, ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা পার হওয়ার পর ২১৪ জন বন্দিকে হত্যা করা হয়েছে। তারা সবাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলেও দাবি করা হয়। বিদ্রোহীদের তরফে তাদের বন্দি নেতাদের মুক্তি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল। বিদ্রোহীদের তরফে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের ওপর হামলার চেষ্টা করলে ইসলামাবাদে হামলা চালানো হবে। একের পর এক হামলার ঘটনা যেভাবে ঘটছে, তাতে এই হুমকির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। একই সঙ্গে এটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামর্থ্যকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কারণ পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার থাকলেও কার্যত নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো আসে ক্যান্টনমেন্ট থেকে। আর বেলুচিস্তান প্রশ্নে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে এটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের ব্যর্থতা।
প্রসঙ্গত, বেলুচিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কোয়েটায় নাগরিক সংগঠন বালুচ ইয়াকজেহতি কমিটির (বিওয়াইসি) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিবার্গ জেহরি, তার ভাই হাম্মাল জেহরি, মানবাধিকারকর্মী সাঈদা বালুচসহ বেশ কয়েকজন বালুচ কর্মীর জোরপূর্বক গুম করার প্রতিবাদে কয়েক দিন ধরে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। তাদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনরত সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। বালুচ ন্যাশনাল মুভমেন্ট (বিএনএম) এবং বালুচ স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন-আজাদের কর্মীদের নিশানা করে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর দমনাভিযানে নারী-শিশুও আক্রান্ত হয়। এতে বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে।
বালুচ আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র মাহরং বালুচ এক ভিডিও বার্তায় অভিযোগ করেছেন, পাকিস্তান সরকার প্রথম থেকেই বালুচ জনগণের ন্যায্য দাবিকে সহিংস দমন-পীড়নের মাধ্যমে দমিয়ে রাখছে। ২২ মার্চ ভোরে বিক্ষোভস্থলে নিরাপত্তা বাহিনীর হামলায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নেয়। লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ এবং নির্বিচারে গণগ্রেপ্তারের মাধ্যমে আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করা হয়। পরিস্থিতি আরো মারাত্মক হয়ে ওঠে, যখন সেনাবাহিনীর গুলিতে তিনজন বিক্ষোভকারী নিহত হন। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তবে বেলুচিস্তানে চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘন আন্তর্জাতিক মহলের নজর এড়ায়নি। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের (ইউএনএইচআরসি) ৫৮তম অধিবেশনে এই পরিস্থিতি গুরুতরভাবে উত্থাপিত হয়েছে। ২২ মার্চ মাহরং বালুচকে গ্রেপ্তার করা হয়। বালুচ জাতীয় আন্দোলনের নেতা নিয়াজ বালুচ বলেছেন, ‘জোরপূর্বক গুম করে ফেলা এখন বেলুচিস্তানে নিপীড়নের একটি পদ্ধতিগত অস্ত্র হয়ে উঠেছে।’ তিনি অভিযোগ করেন, বিবার্গ জেহরি, হাম্মাল জেহরি এবং আরো বহু বালুচ কর্মীকে পরিকল্পিতভাবে গুম করা হয়েছে। পাশাপাশি, নিরাপত্তা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেলুচিস্তানের সংকটকে আরো ঘনীভূত করছে। নিয়াজ বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সরকার সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে বালুচ জনগণের ওপর দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে বহু পরিবার সম্মিলিত শাস্তির শিকার হচ্ছে।’ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে বেলুচিস্তানে সহিংসতার মাত্রা আরো বৃদ্ধি পাবে বলেও আশঙ্কা এই মানবাধিকারকর্মীর।