
গাজা সীমান্তের বড় এলাকা দখলে নিয়ে বাফার জোন তৈরি করেছে ইসরায়েল। ছবি: এপি
যুদ্ধবিরতি ভেঙে চলতি বছরের ১৮ মার্চ নতুন করে গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এ পর্যন্ত অবরুদ্ধ উপত্যকাটির ৫০ শতাংশ এলাকা দখলে নিয়েছে ইসরায়েলি সেনারা। এতে সেখান থেকে সরে যাওয়া ফিলিস্তিনিরা ভবিষ্যতে আর কখনো ফিরতে পারবেন কি না সেটি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এমন তথ্য উঠে এসেছে সোমবার বার্তাসংস্থা এপির এক প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি সেনাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বৃহত্তম সংলগ্ন এলাকাগুলো হলো গাজা সীমান্তের আশপাশ। ওই এলাকাটিতে সেনারা ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর, কৃষিজমি এবং অবকাঠামোকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে।
গত মাসে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় নাটকীয়ভাবে তার অবস্থান বাড়িয়েছে। তারা এখন ৫০ শতাংশেরও বেশি ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে এবং ফিলিস্তিনিদেরকে অল্প এলাকার মধ্যে সঙ্কুচিত করে ফেলছে।
ইসরায়েল তার কঠোর নিয়ন্ত্রণকে হামাসের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য একটি অস্থায়ী প্রয়োজনীয়তা হিসাবে হাজির করেছে। দেশটির দাবি তারা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার সময় নিয়ে যাওয়া জিম্মিদের মুক্তির জন্য নতুন করে যুদ্ধ শুরু করেছে।
তবে মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং গাজা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েলের দখলে থাকা ভূমির মধ্যে একটি করিডর রয়েছে। এটি ভূখণ্ডটিকে উত্তর থেকে দক্ষিণে বিভক্ত করেছে। দীর্ঘমেয়াদী নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য ইসরায়েল এই করিডর ব্যবহার করতে পারে। গত সপ্তাহেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, হামাস পরাজিত হওয়ার পরেও ইসরায়েল গাজার নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে এবং ফিলিস্তিনিদের চলে যেতে বাধ্য করবে।
পাঁচ জন ইসরায়েলি সেনা এপিকে জানান, ১৮ মাস আগে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি সীমান্তের কাছে ধ্বংসযজ্ঞ এবং বাফার জোনের পদ্ধতিগত সম্প্রসারণ চলছে। “তারা যা কিছু গড়ে তুলেছিল তা ধ্বংস করা হয়েছে, যা কিছু এখনও চালু আছে বলে মনে হচ্ছে সেগুলোতেও গুলি করা হচ্ছে... (ফিলিস্তিনিদের) ফিরে আসার মতো কিছুই থাকবে না, তারা ফিরে আসবে না, কখনও নয়,” পাহারা দেওয়া ট্যাংক স্কোয়াডের একজন সেনা এমনটাই বলেছেন।
ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স নামে ইসরায়েলের একটি অধিকার সংগঠন জানিয়েছে, সেনারা অঞ্চলটিকে একটি বিশাল মরুভূমিতে পরিণত করেছে। ব্যাপক ও ইচ্ছাকৃত ধ্বংসের মাধ্যমে তারা ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের ওপর ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণের ভিত্তি স্থাপন করবে। যুদ্ধের প্রথম দিকে ইসরায়েলি সেনারা সীমান্তের কাছাকাছি সম্প্রদায় থেকে ফিলিস্তিনিদের জোর করে তাড়িয়ে দেয় এবং এক কিলোমিটারের বেশি গভীরে একটি বাফার জোন তৈরি করার জন্য জমি ধ্বংস করে।
তারা গাজাজুড়ে ‘নেটজারিম করিডর’ নামে পরিচিত একটি জমিও দখল করে যা গাজাকে সংকীর্ণ উপকূল থেকে বিচ্ছিন্ন করে। গত মাসে ইসরায়েল যখন যুদ্ধ আবার শুরু করে, তখন তারা বাফার জোনের আকার দ্বিগুণ করে। সামরিক বাহিনীর মানচিত্র অনুযায়ী এটি গাজার অভ্যন্তরে তিন কিলোমিটার পর্যন্ত ঠেলে দেয়।
গত সপ্তাহে নেতানিয়াহু জানান, ইসরায়েল দক্ষিণ গাজা জুড়ে আরেকটি করিডর তৈরি করতে চায়, যা রাফা শহরকে বাকি অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। ইসরায়েলের বাফার জোন এলাকাটি গাজার কৃষি উৎপাদনের মূল এলাকা ছিল। সেখানে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বাস করত।
স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায়, একসময় ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর থেকে প্রায় এক ডজন নতুন ইসরায়েলি সেনা ফাঁড়ি তৈরি করেছে।
যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ এবং স্থল আক্রমণের ফলে গাজার বিশাল শহর ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে আরও ব্যাপকভাবে বাফার জোনের ভেতরের সম্পত্তি পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সেনারা।
বেশ কয়েকজন সেনা জানিয়েছেন, তাদের ইউনিটগুলো হিসাবের চেয়েও বেশি ভবন ধ্বংস করেছে, যার মধ্যে বৃহৎ শিল্প কারখানাও রয়েছে। একটি সোডা কারখানা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেনারা জানিয়েছে, বাফার জোনের কোনো চিহ্নিত সীমানা নেই। তবে যারা প্রবেশ করেছিল তাদেরকে গুলি করা হয়েছে।
ট্যাংক স্কোয়াডের সেনারা জানিয়েছে, একটি সাঁজোয়া বুলডোজার জমিটিকে সমতল করে একটি “হত্যা অঞ্চল” তৈরি করেছে এবং ট্যাংকের ৫০০ মিটারের মধ্যে যে কেউ আসবে তাকে গুলি করা হবে, এর মধ্যে কেউ যদি নারী ও শিশুও হয়।
এক সেনা বলেন, “৭ অক্টোবরের হামলার প্রতিশোধ নিতে অনেক সেনা কাজ করছে।” “আমি সেখানে এসেছিলাম কারণ তারা আমাদের হত্যা করে এবং এখন আমরা তাদের হত্যা করতে যাচ্ছি। আমি জানতে পেরেছি যে আমরা কেবল তাদের হত্যা করছি না, আমরা তাদের স্ত্রী, তাদের সন্তান, তাদের বিড়াল, তাদের কুকুর হত্যা করছি এবং আমরা তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করছি,”
ইসরায়েল কতক্ষণ বাফার জোন এবং গাজার অভ্যন্তরে অন্যান্য অঞ্চল ধরে রাখতে চায় তা স্পষ্ট নয়। দক্ষিণ গাজা জুড়ে নতুন করিডর ঘোষণা করার সময় নেতানিয়াহু বলেন, “ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো হামাসকে চাপ দেওয়া যাতে বাকি ৫৯ জন জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয়।” কিন্তু, ধারণা করা হচ্ছে এদের ৩৫ জনই নিহত হয়েছেন।
নেতানিয়াহু বলেন, “যুদ্ধ কেবল তখনই শেষ হতে পারে যখন হামাস ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এর নেতারা গাজা ছেড়ে চলে যাবে। তিনি আরও বলেন, “ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান বাস্তবায়ন করবে।”একে ইসরায়েল "স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়া’ বলে অভিহিত করেছেন তিনি।
কিছু ইসরায়েল বিশ্লেষক বলছেন, বাফার জোনের উদ্দেশ্য গাজা দখল করা নয় বরং হামাস ভেঙে না ফেলা পর্যন্ত এটি সুরক্ষিত করা। তবে অধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, জোর করে মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা একটি সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ।
ইসরায়েল অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেছে। দেশটির দাবি তারা বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিচ্ছে।