Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ওয়াক্ফ বিল-২০২৫: মুসলিমবিদ্বেষের আরেক প্রকাশ

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৩৪

ওয়াক্ফ বিল-২০২৫: মুসলিমবিদ্বেষের আরেক প্রকাশ

ভারতে মুসলমানরা বরাবরই আক্রান্ত হচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী শক্তি ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে একের পর এক মুসলিমবিদ্বেষী অবস্থান ও আইনি আগ্রাসন চলমান রয়েছে। মুসলমানরা বরাবরই আক্রান্ত হয়েছেন খাবার, পোশাক, এমনকি হিন্দু-মুসলিম বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে। সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ভোট সংরক্ষণই এর মূল কারণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। গত সপ্তাহে এমনই একটি বিতর্কিত বিল পাস হয়েছে ভারতের পার্লামেন্টে। এতে যেভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে তাতে কোনো গণতান্ত্রিক রীতি মানা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। 

দেশটির ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ধর্মসংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে এত গুরুতর বিল এসেছে এবং পাস হয়েছে এমন একসময় যখন মন্ত্রিসভায় কিংবা শাসকদলের মধ্যে একজনও মুসলিম প্রতিনিধি নেই। কোনো নাগরিক পর্যায়ে বিতর্কের সুযোগও রাখা হয়নি। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক বিভক্তি আছে। কিন্তু এই বিল উত্থাপন বা পাস করার ক্ষেত্রে কোনো পক্ষের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। বিরোধী দল কংগ্রেস তীব্র সমালোচনা করেছে এই বিলের। এর উত্তরে বিজেপির পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা ইনক্লুসিভিটি বা অন্তর্ভুক্তিমূলক চর্চার লক্ষ্যেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

বিলটি নিয়ে ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় উত্তপ্ত বিতর্ক হয়। ২ থেকে ৩ এপ্রিল ভোর পর্যন্ত চলেছে লোকসভায় আলোচনা। আর রাজ্যসভায় টানা ১৬ ঘণ্টা ধরে হয়েছে তীব্র বাগবিতণ্ডা। কংগ্রেস বলেছে, এই বিল অসাংবিধানিক এবং মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যমূলক। লোকসভায় এই বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন ২৮৮ জন সদস্য, আর বিপক্ষে ২৩২ জন। রাজ্যসভায় ১২৮ জন বিলের পক্ষে ও ৯৫ জন এর বিরুদ্ধে ভোট দেন। প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদী মুর্মুর অনুমোদনের মাধ্যমে বিলটি আইনে পরিণত হয়।

ওয়াক্ফর দেখাশোনা ও ব্যয় নির্ধারণের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভারতের অনেক সনাতন আশ্রম ও মন্দির নিয়েও এমন প্রশ্ন রয়েছে। এ জন্য কোনো আশ্রম বা মন্দির কমিটিতে অহিন্দু কাউকে যুক্ত করার বিধান আনা হয়নি; যেমনটা ওয়াক্ফ বিলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ওয়াক্ফ কাউন্সিল এবং রাজ্য ওয়াক্ফ বোর্ডগুলোতে এখন থেকে দুজন করে অমুসলমান প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তারা নীতীশ কুমারের জেডি (ইউ) আর চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপির সঙ্গে জোট বেঁধে এনডিএ সরকার গঠন করে। এই বিলের ক্ষেত্রে জোটের সঙ্গীদের পক্ষ থেকেও কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। টিডিপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা যে সংশোধনীর প্রস্তাব দিয়েছিলেন সেগুলো মেনে নেওয়ায় তাদের দিক থেকে বিল নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তথ্য জানানোর সময়সীমা, ওয়াক্ফ বোর্ডে রাজ্য সরকারের আংশিক ভূমিকা ইত্যাদি খুঁটিনাটি পদ্ধতিগত সংশোধনী ছাড়া আর কোনো বক্তব্যই তাদের ছিল না। নিজেদের রাজ্যের মুসলমান সমাজের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার চাপও তাদের নেই। কারণ মুসলিম ভোটারদের তারা হিসাবের বাইরে রেখেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চান। সংখ্যাগুরুবাদের এই চাপ কার্যত ভারতজুড়ে মুসলিমদের সহনাগরিকের তকমা থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রয়াস বলেই মনে করছেন অনেকে।

নতুন বিলে ওয়াক্ফ করা জমির মালিকানা যাচাইয়ে সরকারের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। সরকার অবশ্য বলছে, এতে দুর্নীতি কমবে, ব্যবস্থাপনা হবে সুষ্ঠু আর বৈচিত্র্য বাড়বে। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, এই বিল মুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকারে আঘাত হানবে। আর সেই সুযোগে পুরোনো মসজিদসহ বহু ঐতিহাসিক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।

অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের মতো সংগঠনগুলো বলছে, এই বক্তব্য ইসলামি ওয়াক্ফ ব্যবস্থার মূল চেতনার পরিপন্থি। তাদের মতে, ওয়াক্ফ বোর্ডের পরিচালনা মুসলমানদের দ্বারাই হওয়া উচিত। তারা একে মুসলিম নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারে সরাসরি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। এই বিলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়েছে বোর্ড।

ওয়াক্ফ সম্পত্তির ধারণাটির মধ্যে বহু দশক যাবৎ সামাজিক বৈষম্যের অভিযোগ রয়েছে। নতুন আইনে এই সমস্যা সমাধানের বিস্তর অবকাশ ছিল। অথচ ধর্মীয় ধারণাকে পুঁজি করা আইনে সামাজিক ন্যায়ের প্রসঙ্গটি বাদ দেওয়া হয়েছে। যেমনভাবে সাচার কমিটির প্রতিবেদনের পরও ওবিসি (অন্যান্য পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী) সংরক্ষণ প্রশ্নে ধর্মসংক্রান্ত খুঁটিনাটির মধ্যে ঢুকে সামাজিক ন্যায়ের মৌলিক চিন্তা থেকে গেছে বিতর্কের বাইরে। ওয়াক্ফ আইনটি যেভাবে পাস হয়েছে তাতে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় আরেক দফা আগ্রাসনের শিকার হলো।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫