Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ট্রাম্পের শুল্ক নীতিতে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শঙ্কায় বিশ্ব

Icon

তৌসিফ আহমেদ

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১৬

ট্রাম্পের শুল্ক নীতিতে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শঙ্কায় বিশ্ব

ট্রাম্পের শুল্ক নীতি। ছবি: সংগৃহীত

‘যুক্তরাষ্ট্র হাঁচি দিলেই বিশ্ব সর্দি জ্বরে ভোগে’- এই প্রবাদটি শুনে অনেকেই হয়তো হাসবেন, তবে এর ভেতরে যে অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতির এক নিখুঁত চিত্র আছে, তা অস্বীকার করা কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। সেখানকার নীতিগত কোনো পরিবর্তন গোটা বিশ্বের জন্য এক ভয়াবহ কম্পনের মতোই। তবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এই প্রবাদটিও যেন যথেষ্ট নয়- বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির প্রেক্ষাপটে।

২ এপ্রিল হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে ‘Make America Wealthy Again’ শিরোনামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প ঘোষণা দেন, যুক্তরাষ্ট্রে আসা সব আমদানীকৃত পণ্যের ওপর নতুন একটি শুল্ক আরোপ করা হবে। শুধু তাই নয়, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারদের পণ্যের ওপর যথাক্রমে ৩৪ শতাংশ ও ২০ শতাংশ হারে অতিরিক্ত শুল্ক বসানোর কথাও জানান তিনি।

এই ঘোষণাকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘হাঁচি নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র যেন নিজের একটি অঙ্গ কেটে ফেলেছে।’ ইউবিএস গ্লোবাল ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ পল ডোনোভান এক সাক্ষাৎকারে জানান, বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি একটি চমৎকার জায়গায় ছিল। কিন্তু এই ধারাবাহিক শুল্ক আরোপের কারণে অর্থনীতি এখন এক রিসেশন বা মন্দার দ্বারপ্রান্তে।

শুল্ক বৃদ্ধির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাপর্যায়ে পণ্যের দাম বাড়বে। আর্থিক পরিষেবা প্রতিষ্ঠান জেপি মর্গানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই শুল্কনীতির ফলে ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা মূল্যসূচক বা সিপিআই প্রায় ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি তারা বলছে, এই শুল্কনীতি মূলত এক ধরনের কর বৃদ্ধির সমান, যার পরিমাণ প্রায় ৬৬০ বিলিয়ন ডলার- এটা সাম্প্রতিক ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কর বৃদ্ধি। এই সিদ্ধান্তের প্রভাব শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং গোটা বিশ্বে তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়বে। যেহেতু মার্কিনিরা বিশাল ভোক্তা শ্রেণি, তাদের খরচ কমে গেলে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর রপ্তানি কমবে। ফলে চীন, জার্মানি বা বাংলাদেশের মতো রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি সংকটে পড়বে। নতুন শুল্কের ফলে উৎপাদকরা বিনিয়োগে হ্রাস ঘটাতে পারেন, কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে।

Deutsche Bank-এর গবেষণায়ও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে মন্দার আশঙ্কা এখন অনেক বেশি। একই সঙ্গে ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে আগামী ১২ থেকে ১৮ মাসে বেকারত্ব বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে তারা। কারণ যদি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে যায়, তাহলে সেই বাজারে পণ্য রপ্তানিকারক দেশের উৎপাদন হ্রাস পাবে, যা সরাসরি কর্মসংস্থানে প্রভাব ফেলবে।

তবে এখানেই শেষ নয়। বিশ্ব অর্থনীতি আরেক বড় ধাক্কা খেতে পারে, যদি যুক্তরাষ্ট্র এই একতরফা শুল্কনীতির জবাবে অন্যান্য দেশ পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, তারা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং পাল্টা ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত। ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ইইউ সরাসরি পাল্টা শুল্ক না দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু মার্কিন প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্যবস্তু করতে পারে। অন্যদিকে চীন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের এই একতরফা দাদাগিরির সমুচিত জবাব দেবে। পূর্বে ট্রাম্প প্রশাসনের অ্যালুমিনিয়াম ও স্টিল শুল্কের জবাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রায় ২৬ বিলিয়ন ইউরোর মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক বসিয়েছিল। এতে মোটরসাইকেল, বোরবন হুইস্কি, নৌকা ইত্যাদির দাম বেড়ে যায়। এবারের প্রতিক্রিয়ায় একই ধরনের পদক্ষেপ আসবে কি না, সেটা সময়ই বলবে। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছোট ব্যবসা ও উন্নয়নশীল অর্থনীতি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হলে ছোট ছোট কোম্পানির ওপর চাপ বাড়বে। সরবরাহ চেইন ব্যাহত হবে। আমদানি-রপ্তানির ব্যয় বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে উঠবে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েন বলেছেন, ‘প্রথম দিন থেকেই ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়বে।’

বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতির প্রবণতা বাড়বে, আর্থিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হবে। ফরাসি ইনসিয়েড বিজনেস স্কুলের অর্থনীতিবিদ আন্তোনিও ফাতাস জানিয়েছেন, ‘যদি দেশগুলো পালটা প্রতিক্রিয়া দেয়, তাহলে অন্য দেশেও মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি হবে।’ তবে এই অন্ধকারে খানিকটা আশাবাদ ব্যক্ত করেছে অক্সফোর্ড ইকোনমিকস। তাদের মতে, বিশ্ব অর্থনীতি হয়তো সরাসরি মন্দায় না-ও পড়তে পারে, তবে ২০২৫ সালে প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশের নিচে নেমে যেতে পারে। এই হারে প্রবৃদ্ধি সাম্প্রতিক অতীতে কেবল কোভিড মহামারির সময়েই দেখা গিয়েছিল।

সব মিলিয়ে বলা যায়, ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির প্রভাব কেবল কোনো একটি দেশের সীমায় আবদ্ধ থাকছে না। এই সিদ্ধান্তের কম্পন গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। ‘যুক্তরাষ্ট্র হাঁচি দিলেই বিশ্ব সর্দি জ্বরে ভোগে’- এই প্রবাদটি এখন শুধু কথার কথা নয়, বরং বাস্তবতার ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫