
ভারতের সেভেন সিস্টার্সের মানচিত্র।
ভারতের সেভেন সিস্টার্স ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। তাই একে নিয়ে আশপাশের অঞ্চলের মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি মন্তব্য অঞ্চলটিকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে। এই সুযোগে আমরা বরং জেনে নেই সেভেন সিস্টার্স সম্পর্কে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত সাত রাজ্য অরুণাচল, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরাকে একত্রে ‘সেভেন সিস্টার্স’ বলা হয়। নামটি প্রথম পরিচিতি পায় ত্রিপুরার সাংবাদিক জ্যোতি প্রসাদ শইকিয়ার মাধ্যমে। ১৯৭২ সালে এক রেডিও টকশোতে তিনি প্রথমবারের মতো এটি উল্লেখ করেন।
উত্তর-পূর্ব ভারতের এই সাত রাজ্যকে মনে করা হয় একটি পরিবারের মতো। কারণ এই রাজ্যগুলো অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান। এটি তাদের মধ্যে এক বৈচিত্র্যময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এই সাত রাজ্য যেন সাত বোনের মতো। যারা মায়া-মমতায় একে অপরকে জড়িয়ে রেখেছে। সে বিবেচনায় সেভেন সিস্টার্স বা ‘সাত বোন’ উপমা সার্থক। তা ছাড়া ভৌগোলিকভাবেও কিন্তু রাজ্যগুলো পরস্পরের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। মানচিত্রের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়।
মজার ব্যাপার হলো, সেভেন সিস্টার্স নামের এ অঞ্চলটি বাংলাদেশ ও চীন থেকে যতটা কাছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে ততটা নয়। এই ‘ল্যান্ড লকড’ সাতটি রাজ্যের সবচেয়ে কাছের সমুদ্রটি হলো বঙ্গোপসাগর।
চীন সফরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যকে (সেভেন সিস্টার্স) স্থলবেষ্টিত বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশকে এ অঞ্চলে সমুদ্রের অভিভাবক হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। আসলে চীনকে বাংলাদেশে
গুরুত্ব বোঝাতে গিয়েই ড. ইউনূসের এই বক্তব্য। তবে এই বক্তব্যে অবশ্য ভারতের উচ্চমহল বিশেষ খুশি হয়নি। ভারতের ‘মেইনল্যান্ড’, অর্থাৎ পশ্চিমাঞ্চল থেকে সেভেন সিস্টার্স খ্যাত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যেতে পাড়ি দিতে হয় খুব সংকীর্ণ একটি পথ। ওই পথের নাম শিলিগুড়ি করিডর বা ‘চিকেন নেক’। চিকেন নেকের তিন দিকে ঘিরে আছে তিনটি দেশ। উত্তর-পশ্চিমে নেপাল, দক্ষিণ-পশ্চিমে বাংলাদেশ ও উত্তরে ভুটান। সেভেন সিস্টার্স বা সাত রাজ্যের এই উত্তর পূর্বাঞ্চল হলো স্থলবেষ্টিত। ‘চিকেন নেক’- ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে, বাকি ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করার একমাত্র পথ। ফলে ভূ-রাজনৈতিকভাবে এই পথ ভারত রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া এই করিডরের নাকের ডগায় অবস্থান করছে ডোকলাম। যেটি চীন ও ভুটানের একটি অমীমাংসিত এলাকা।
দুই লাখ ৬২ হাজার ২৩০ বর্গকিলোমিটারের এই সাত রাজ্যে বসবাস করছে বহু জাতিগোষ্ঠী। ধারণা করা হয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের এই জাতিগোষ্ঠীগুলোর পূর্ব পুরুষরা হলো মঙ্গোলয়েড, ইন্দো-আর্য, অস্ট্রালয়েড বা অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়। এই অঞ্চলে বহু প্রাচীনকাল থেকে তিব্বত, ইন্দো-গাঙ্গেয় ভারত, হিমালয়, বর্তমান বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে অভিবাসীরা এসে বসবাস করতে শুরু করে। অঞ্চলটির আজকের জনসংখ্যা সে ধারাবাহিকতারই ফল।
এই সাত রাজ্যে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে অসমিয়া, ভুটিয়া, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, চাকমা, ছেত্রী, গারো, গুরুং, হাজং, কারবি, খাসি, কোচ, কোম, কুকি, পৈতে, বৈফেই, তেদ্দিম, সিমতে, গাংতে, লেপচা, লুসাই, মেইতৈ, মিসিং, মিজো, মাও, মারাম, তাংখুল, আনাল, মংসাং, নাগা, নেপালি, মৈথিলি, রাভা, রিয়াং, রোংমেই, সিংফো, সিলেটি, তিব্বতি, টিওয়া, ত্রিপুরা, জেমে নাগা, চোরেই ও লিম্বু। এরা সবাই এই অঞ্চলের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বৈচিত্র্যময় জাতিগত গোষ্ঠী।
অঞ্চলটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। ফলে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এই অঞ্চল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিব্বত, মিয়ানমার ও ভুটান সীমান্তসংলগ্ন সেভেন সিস্টার্সের অন্তর্ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজ্য অরুণাচল। এখানকার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। এখানে ধান, ভুট্টা, শস্য, গম, ডাল, আখ, আদা, তেলবীজ, খাদ্যশস্য, আলু ও আনারসের চাষ করা হয়। এ ছাড়া এই অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খনিজ সম্পদ রয়েছে।
আরেক রাজ্য আসাম বিস্তীর্ণ উর্বর ভূমি এবং পানিসম্পদে সমৃদ্ধ। আসাম হলো ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী রাজ্য। এই রাজ্যে পাঁচটি জাতীয় উদ্যান আর ১৮টি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য রয়েছে। আসাম ভারতের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম হটস্পট।
ভারতের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় যে রাজ্যে, সেই মেঘালয়ও সেভেন সিস্টার্সের অন্তর্ভুক্ত। কৃষিনির্ভর এই রাজ্যে ধান, ভুট্টা, ডাল, তেলবীজ, তুলা, পাট ও মেস্তার চাষ হয়। আর হস্তশিল্পের জন্য বিখ্যাত মণিপুর।
খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ রাজ্য নাগাল্যান্ড। এই রাজ্যে বিপুল পরিমাণ পেট্রোলিয়াম মজুদ আছে। আছে ৬০ কোটি মেট্রিক টন অপরিশোধিত তেল এবং দুই কোটি মেট্রিক টন হাইড্রোকার্বন। পাশাপাশি এই রাজ্যে রয়েছে ৩১ কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন কয়লা এবং প্রায় ১০৪ কোটি মেট্রিক টন চুনাপাথরের ভান্ডার।
সেভেন সিস্টার্সের চারটি রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও মিজোরামের সঙ্গে বাংলাদেশ তার সীমানা ভাগাভাগি করছে। এ সীমানার মোট আয়তন এক হাজার ৫৯৬ কিলোমিটার।
শুধু পর্যটনশিল্পের দিক থেকেই যদি সেভেন সিস্টার্সের গুরুত্ব বিবেচনা করা হয়, তবে কয়েক কথায় লিখে শেষ করতে গেলে বেশ মুশকিলই হয়ে যাবে।
প্রথমেই বলতে হবে তাওয়াং মঠের কথা। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বৌদ্ধ মঠ অরুণাচল প্রদেশে অবস্থিত। নদী, চা-বাগান আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার আসাম। বিশ্বের বৃহত্তম নদী দ্বীপ মাজুলি আসামে। আর মণিপুরের প্রধান আকর্ষণ এর বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও খাবার। মণিপুরী নৃত্যের খ্যাতি তো বিশ্বজোড়া।
চেরাপুঞ্জির কথা মনে এলেই চোখে ভাসে কেবল অঝোরে বৃষ্টির এক অনন্ত দৃশ্য। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপ্রবণ এই অঞ্চলটি মেঘালয়ে।
নাগাল্যান্ড রাজ্যে প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পালিত হয় হর্নবিল উৎসব। এ উৎসবে নাগাল্যান্ডের ১৭টি ভিন্ন ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি প্রদর্শিত হয়। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
এই উৎসবকে বলা হয় ‘উৎসবের উৎসব’। এখানে নাগা সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য প্রদর্শনী যেমন দেখা যায়, তেমনি দেখা যায় ঐতিহ্যবাহী নৃত্য, উপভোগ করা যায় সংগীত ও স্থানীয় খাবার।
পর্যটকদের জন্য আধুনিক সুবিধা এবং ঐতিহাসিক স্থাপনার এক অনন্য সংমিশ্রণ হলো ত্রিপুরা রাজ্য। দর্শনীয় স্থানগুলো হলো, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, কসবা কালীমন্দির, গেদু মিয়া মসজিদ ও উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ।
সেভেন সিস্টার্সের আসাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা রাজ্যে বিমানবন্দর আছে। বাংলাদেশ থেকে বিমানযোগে তাই এই রাজ্যগুলোতে সরাসরি ভ্রমণ করা যাবে।
বাংলাদেশ থেকে অনেক পর্যটক প্রতিবছর সেভেন সিস্টার্সের নানা জায়গায় ভ্রমণ করে। যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারত পর্যটন ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে।
তবে জেনে রাখা ভালো ভারতের সেভেন সিস্টার্সে ভ্রমণ করতে হলে বাংলাদেশের বেনাপোল, আগরতলা, ডাউকি ও বুড়িমারী সীমান্ত দিয়েই প্রবেশ করতে হবে।
সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া টুডে, দ্য হিন্দু, জার্নাল স্টোরেজ (জেএসটিওআর), ট্র্যাভেল ট্রায়াঙ্গেল, জাগরণ জোশ ডটকম, নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া : ল্যান্ড, পিপল অ্যান্ড ইকোনমি, আইবিইএফ।