Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

লিংচি: প্রাচীন চীনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের এক নৃশংস পদ্ধতি

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৫, ১১:১৫

লিংচি: প্রাচীন চীনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের এক নৃশংস পদ্ধতি

প্রতীকী ছবি

চীনে আনুমানিক দশম শতাব্দী থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বছর ধরে নিষ্ঠুরতম এক মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতি চালু ছিল, যা লিংচি নামে পরিচিত। লিংচি চীনা শব্দ। যার আক্ষরিক অর্থ হাজার টুকরো করে মৃত্যু দেওয়া বা স্লো স্লাইসিং (ধীরে ধীরে অঙ্গ কাটা)। নাম থেকেই বোঝা যায়, এটি ছিল এক নৃশংস ও নির্মম প্রক্রিয়া- এ পদ্ধতিতে অপরাধীকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হতো।

বেশির ভাগ মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতিতে অপরাধীর দ্রুত মৃত্যু ঘটানোই থাকে লক্ষ্য, কিন্তু লিংচির উদ্দেশ্য ছিল অপরাধীকে দীর্ঘ সময় ধরে তীব্র যন্ত্রণা দেওয়ার মাধ্যমে মৃত্যু ঘটানো। লিংচির প্রক্রিয়াটি ছিল তুলনামূলকভাবে সাধারণ। বন্দি বা দোষী ব্যক্তিকে একটি কাঠের খুঁটির সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হতো, যাতে সে পালাতে বা নড়াচড়া করতে না পারে। জর্জ আর্নেস্ট মরিসনের An Australian in china বইতে উল্লেখ আছে, অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে আফিম খাওয়ানো হতো। তারপর ধারালো ছুরি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশের মাংস কাটা শুরু করা হতো। প্রথমে বুক থেকে কাটা শুরু হতো। স্তনসহ আশপাশের মাংসপেশি কেটে ফেলা হতো যতক্ষণ না পাঁজরের হাড় স্পষ্ট দেখা যায়।

এরপর হাতের চামড়া ছিঁড়ে ফেলে মাংস উন্মুক্ত করা হতো। একই কৌশলে ঊরুতেও কাটাকাটি চলত। এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হাড় দৃশ্যমান না হওয়া পর্যন্ত শরীরের মাংস ধীরে ধীরে খুলে নেওয়া হতো। এই পর্যায়ে এসে অনেক সময় অপরাধী মারা যেতেন। এই শাস্তি প্রক্রিয়াটি খুবই ধীর গতিতে চলত। পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে তিন দিনের বেশি সময় লাগত এবং এতে করে তিন হাজারেরও বেশি বার শরীরে ছুরিকাঘাত করতে হতো। চীনা আইনে নির্দিষ্ট করে কাটার  পদ্ধতির কথা বলা ছিল না। তাই অঞ্চলভেদে লিংচির প্রক্রিয়া ভিন্ন ছিল। কোথাও মৃত্যুদণ্ড ১৫ মিনিটেই শেষ হয়ে যেত, আবার কোথাও এটি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলত। তবে অনেক সময় দুর্বল অপরাধীদের জন্য কিছুটা দয়া দেখানো হতো। অনেক পরিবার কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিত, যাতে প্রথম আঘাতই দণ্ডিতের শেষ আঘাত হয়।

লিংচি সবার জন্য ছিল না। রাষ্ট্রদ্রোহ, গণহত্যা, পিতৃহত্যা, মাতৃহত্যার মতো  গুরুতর অপরাধের জন্যই লিংচি পদ্ধতির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হতো। জানা যায়, জনৈক এক ব্যক্তি ১৮২ জন নারীকে ধর্ষণ করার দায়ে লিংচিতে দণ্ডিত হয়েছিল। ১৫৪২ সালে, তৎকালীন সম্রাটকে হত্যার চেষ্টার দায়ে ১৬ জন রাজকীয় দাসীকে লিংচিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৫১০ সালে লিগ জিন নামের এক শাসনকর্তা লিংচিতে দণ্ডিত হন। তাকে দুই দিন ধরে লিংচি পদ্ধতির মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ১৮৯৫ সালে হেনরি নড়ান নামের এক ব্রিটিশ সাংবাদিক একটি চীনা পত্রিকার রিপোর্ট উদ্ধৃত করেন, যেখানে এক নারীর মৃত্যুদণ্ডের বর্ণনা ছিল অনেকটা এ রকম- ‘এক নারী তার স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হয়ে এক ওষুধ বিক্রেতার সঙ্গে পরামর্শ করে পাহাড় থেকে বিষাক্ত উদ্ভিদ সংগ্রহ করে তার স্বামী, শ্বশুর ও দেবরকে বিষ খাইয়ে হত্যা করে। এই অপরাধে তাকে ধীরে ধীরে কেটে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।’

যদিও অনেক গল্পই অতিরঞ্জিত, যা পশ্চিমাদের বর্ণনা দ্বারা প্রভাবিত। ১৯০৫ সালে ফৌচৌলি নামক এক ব্যক্তির বাস্তব ছবি তোলা হয় মৃত্যুর আগে। সে তার মনিব, এক মঙ্গোলিয়ান রাজপুত্রকে হত্যা করেছিল। ফটোগ্রাফি ও লিখিত বিবরণ অনুযায়ী, তিনিই সর্বশেষ কোনো ব্যক্তি, যার মৃত্যু লিংচি পদ্ধতির মাধ্যমে হয়েছিল। ১২০০ শতাব্দী থেকেই এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছিল। কবি ও ইতিহাসবিদ লু ইউ লিখেছিলেন, ‘যখন শরীরের মাংস কেটে নেওয়া হয়, তখনো প্রাণ থাকে, হৃদয় ও যকৃত সংযুক্ত থাকে, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি থাকে। এটি প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে, যা মানবিক শাসনের পরিপন্থি ও অনুপযুক্ত।’

তা ছাড়া কনফুসিয়ান বিশ্বাস অনুযায়ী, মৃত্যুর পর শরীর অক্ষত থাকা জরুরি, এই পদ্ধতি সেই বিশ্বাসকেই ভঙ্গ করত। সুতরাং এটি শুধু একটি শারীরিক শাস্তিই নয়, বরং সামাজিক ও আত্মিক অপমানও ছিল। ১৯০৫ সালে এটি পদ্ধতি নিষিদ্ধ হলেও অনেকের দাবি এর পরও বিচ্ছিন্নভাবে লিংচি কার্যকর করা হয়েছিল। ১৯২৮ সালে গভর্নর ইয়াং ঝেংসিন হত্যাকাণ্ডের পর সন্দেহভাজন ঘাতককে এবং তার কন্যাকেও একইভাবে হত্যা করা হয় বলে শোনা যায়। এমনকি ১৯৩৬ সালে এক কমিউনিস্ট নেতাকেও এভাবে হত্যা করার ঘটনা শোনা যায়।

চীনের শেষ রাজবংশ ‘কিং বংশ’ (১৬৪৪-১৯১১) তাদের রাজত্বের শেষ দিনগুলোতে এই শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়েছিল। যদিও এই ভয়ংকর পদ্ধতি ১৯০৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে এর ভয়াবহ স্মৃতি এখনো মানুষের মনে গভীরভাবে গেঁথে আছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫