Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ফ্রান্সিস: ক্যাথলিক চার্চকে নাড়া দেওয়া এক পোপ

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৩৮

ফ্রান্সিস: ক্যাথলিক চার্চকে নাড়া দেওয়া এক পোপ

পোপ ফ্রান্সিস। ছবি: সংগৃহীত

পূর্বসূরিদের মতো রাজকীয় আড়ম্বর ও বিশেষাধিকার এড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন চিন্তা গ্রহণের মধ্য দিয়ে আধুনিক পোপ কাঠামোর চেহারা বদলে দিয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। তবে ক্যাথলিক চার্চকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কম বিচারমূলক করে তোলার এই প্রচেষ্টা তাকে রক্ষণশীলদের শত্রুতে পরিণত করে। ২১ এপ্রিল ভ্যাটিকানে নিজ বাসভবন কাসা সান্তা মার্তায় মারা যান পোপ ফ্রান্সিস। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত পোপকে এ বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। 

ভ্যাটিকানের দাপ্তরিক ওয়েবসাইট ‘দ্য হোলি সি’-এর তথ্য মতে, পোপ ফ্রান্সিসের আগের নাম জর্জ মারিও বারগোগ্লিও। জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর, আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসে। বাবা মারিও আর মা রেগিনা সিভোরি। ইতালীয় অভিবাসী বাবা মারিও ছিলেন রেলওয়ের হিসাবরক্ষক। কেমিস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ধর্মচর্চা পথে পা বাড়ান জর্জ মারিও। পরবর্তী সময়ে তিনি দর্শন ও ধর্মতত্ত্বে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৯ সালে ধর্মযাজক হন। ১৯৯৮ সালে আর্জেন্টিনায় আর্চবিশপ হন। ২০১৩ সালে তৎকালীন পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট পদ ছেড়ে দিলে পোপ নির্বাচিত হন জর্জ মারিও। নতুন নাম নেন ফ্রান্সিস। দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশ থেকে নির্বাচিত প্রথম পোপ তিনি।

বিশ্বব্যাপী রক্ষণশীল ক্যাথলিকবাদ অর্থবহ ডানপন্থি রাজনীতি ও মিডিয়ার সঙ্গে মিশে যায়। এই মেরুকরণ যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে তীব্র। পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে পূর্ববর্তী পোপ বেনেডিক্টও ভ্যাটিক্যানে ছিলেন। ২০২২ সালে বেনেডিক্টের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় এক দশক ধরে ভ্যাটিকানে দুজন সাদা পোশাকধারী ব্যক্তি থাকায় রক্ষণশীলদের ব্যাপক সমালোচনা এবং অনেক ক্ষেত্রে অসহযোগও দেখা যায়। পোপের প্রতি রক্ষণশীলদের বিদ্বেষের মাত্রা ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশ পায়; রক্ষণশীল আন্দোলনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও বেনেডিক্টের মিত্র প্রয়াত অস্ট্রেলিয়ান কার্ডিনাল জর্জ পেল ২০২২ সালে একটি বেনামি মেমো লিখেছিলেন, যাতে ফ্রান্সিসের শাসনকালকে ‘বিপর্যয়’ বলে নিন্দা করা হয়েছিল। এই মেমো মূলত একটি রক্ষণশীল ইশতেহারে পরিণত হয়, যা পরবর্তী পোপের মধ্যে রক্ষণশীলরা কী চায় তার একটি রূপরেখা দেয়।

তবে পরবর্তী পোপ নির্বাচনকারী কার্ডিনাল নির্বাচকদের প্রায় ৮০ শতাংশের নিয়োগ দিয়েছিলেন ফ্রান্সিস, উত্তরসূরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রগতিশীল নীতিগুলো চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়েছে। কিছু ভ্যাটিকান বিশেষজ্ঞ মনে করেছেন, তার উত্তরসূরি হবে আরো সংহত। ফ্রান্সিসের তত্ত্বাবধানে সংস্কার করা ভ্যাটিকান সংবিধান নারীসহ যেকোনো ব্যাপ্টাইজড সাধারণ ক্যাথলিককে চার্চের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বেশির ভাগ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনুমতি দেয়। তিনি পূর্বসূরি কোনো পোপের চেয়ে বেশি নারীকে ভ্যাটিকানের উচ্চপদে নিয়োগ দিয়েছেন; কিন্তু প্রগতিশীলরা যতটা চেয়েছিলেন ততটা সম্ভব হয়নি। 

পোপ ফ্রান্সিস ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। এ সময় তিনি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করে সবার পক্ষ থেকে তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ইউক্রেনে যুদ্ধ শেষ করতে না পারাটা পোপ ফ্রান্সিসের জন্য ছিল বড় হতাশার। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার বিশেষ অভিযানের দিন থেকে তিনি প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুইবার প্রকাশ্যে শান্তির জন্য আবেদন করেছেন। এই সংঘাত ২০২২ সালে ভ্যাটিকান ও রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের মধ্যে সম্পর্ক নিম্নস্তরে নিয়ে যায়, যখন ফ্রান্সিস বলেন, অর্থোডক্স চার্চ এই যুদ্ধ সমর্থন করে কার্যত ‘পুতিনের পোষ্য বালক’-এর মতো আচরণ করে। সেই সঙ্গে তিনি হামাসের হাতে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির দাবি জানান এবং ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসনের সমালোচনা করেন। শেষ দিকে ইসরায়েলি গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে গাজার শিশুদের বাঁচানোর মানবিক আবেদন জানান একাধিকবার।

রক্ষণশীলরা শুরু থেকেই পোপের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল তার অনানুষ্ঠানিক শৈলী, আড়ম্বরের প্রতি বিরাগ এবং নারী ও মুসলিমদের হোলি থার্সডে অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্তের জন্য; যা এর আগে শুধু ক্যাথলিক পুরুষদের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল। ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামী ও হিজড়াদের প্রতি চার্চকে আরো স্বাগত জানানোর আহ্বান জানান, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সমলিঙ্গ দম্পতিদের জন্য শর্তসাপেক্ষে আশীর্বাদ অনুমোদন করেন। 

ধর্মযাজকের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের এবং কানাডার আদিবাসীদের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চেয়ে তিনি আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। ফ্রান্সিস ২০১৯ সালে আরব উপদ্বীপ সফর করেন। ২০২১ সালের মার্চে ইরাক সফর। ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার পাশাপাশি তিনি সেখানকার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

তিনি ফ্রান্সিস নামটি নেন অ্যাসিসির ফ্রান্সিসের সম্মানে; যিনি শান্তি, দরিদ্রদের জন্য উদ্বেগ ও পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৮ সালে রয়টার্সের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ফ্রান্সিস বলেন, ‘আমি আর্জেন্টিনাকে মিস করি না। আমি শুধু পথটাকে মিস করি। আমি পথেরই মানুষ। আমি সত্যিই আবার সে পথে হাঁটতে চাই; কিন্তু এখন তা করতে পারব না।’

চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পেঙ্গুইন র‌্যানডম হাউস থেকে প্রকাশিত হয়েছে পোপ ফ্রান্সিসের আত্মজীবনী ‘হোপ’। ক্যাথলিক গির্জার বেশকিছু উদারনীতি ও সংস্কারের জন্য পোপ ফ্রান্সিস চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সূত্র: রয়টার্স অবলম্বনে

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫