Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ট্রাম্পের শুল্ক রাজনীতির সুযোগে মাথাচাড়া দিচ্ছে মুনাফালোভীরা

Icon

তৌসিফ আহমেদ

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৩৫

ট্রাম্পের শুল্ক রাজনীতির সুযোগে মাথাচাড়া দিচ্ছে মুনাফালোভীরা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত

করোনার পর জীবনযাত্রার খরচ এমনভাবে বেড়েছে যে সাধারণ মানুষের কাছে এখন বাজার করা যেন এক ধরনের মানসিক যুদ্ধ। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সব ক্ষেত্রে খরচ বাড়েনি, অথচ দাম বেড়েই চলেছে। এই বৈপরীত্যের ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে বাজার বিশ্লেষকদের মুখে এখন এক নতুন শব্দ- গ্রিডফ্লেশন (Greedflation)। এটি মূলত ইংরেজি দুটি শব্দের সংমিশ্রণ- ‘গ্রিড’ (লোভ) আর ‘ইনফ্লেশন’ (মুদ্রাস্ফীতি)। গ্রিডফ্লেশন এমন এক মুদ্রাস্ফীতি, যার পেছনে খরচ বৃদ্ধি বা প্রোডাকশন চেইনের চাপ নেই, বরং রয়েছে অতি মুনাফার লোভ।

২০ জানুয়ারি নির্বাচিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় শুল্ক রাজনীতির মাঠে নেমেছেন, আর তাতেই অনেক বড় কোম্পানি যেন পেয়ে গেছে দাম বাড়ানোর দারুণ এক অজুহাত! বিশ্লেষকদের মতে, এমন অনেক পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কোনো শুল্ক না থাকলেও ‘দাম তো বাড়তেই পারে’- এই ভাবনার সুযোগ নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। কারণ ভোক্তারাও এখন যেন মানসিকভাবে প্রস্তুত, দাম তো বাড়বেই! আর সেই প্রস্তুতির ফাঁকেই চলছে অতি মুনাফার খেলাধুলা।

যদিও সম্প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতির হার কিছুটা কমেছে, তবে নতুন করে দাম বৃদ্ধির আতঙ্ক আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি তার বড় বাণিজ্যিক অংশীদারদের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করে এবং তা বজায় রাখে, তবে এর ফলে মার্কিন ভোক্তাদের পকেটেই বেশি চাপ পড়বে। যদিও অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে প্রভাবটা এতটা সরল নয়। তবুও শুধু শুল্ক আসছে- এই ভাবনাটাই অনেক কোম্পানিকে পণ্যের দাম বাড়ানোর ‘জাস্টিফিকেশন’ দিয়ে দিতে পারে। ইউবিএস ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ পল ডোনোভান বলেন, “ভোক্তাদের বোঝানোর জন্য একটি গল্প দরকার- কেন দামের বৃদ্ধি হচ্ছে। আর ‘শুল্ক’ সেই গল্পটা ঠিকঠাকভাবেই সরবরাহ করে।” করোনার পর যে বড় মুদ্রাস্ফীতির ঢেউ এসেছিল, সেটাও মানুষকে কিছুটা মানিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। এখন অনেকেই মনে করে, এই জিনিসটা ঘটতেই পারে, স্বাভাবিক।

মার্কিন ডেমোক্র্যাট সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন সতর্ক করেছেন, ট্রাম্পের এই শুল্কনীতি বড় কোম্পানিগুলোকে মুনাফাখোরি করার নতুন অজুহাত দেবে। এমনকি যেসব পণ্যের ওপর সরাসরি শুল্ক নেই, সেগুলোর দামও বেড়ে যেতে পারে।

কিছুদিন আগে সনি ঘোষণা করেছে, প্লে-স্টেশন ৫-এর দাম বাজারে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হবে। যদিও তারা সরাসরি ট্রাম্পের শুল্কের কথা বলেনি, বরং ‘চ্যালেঞ্জিং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি’কে কারণ হিসেবে দেখিয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটা মূলত ভবিষ্যতের শুল্কের চাপ সামলাতে আগাম প্রস্তুতি। বড় ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর দিক থেকে এটাও বোঝা যাচ্ছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়; যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এমনকি নিউজিল্যান্ডেও দাম বাড়ানো হচ্ছে।

প্যানথিয়ন মাইক্রোইকোনমিক্সের প্রধান অর্থনীতিবিদ ক্লাউস ভিসটেসেন বলেন, ‘ট্রাম্পের শুল্কনীতি কিভাবে আন্তর্জাতিকভাবে মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে পারে, সনির সিদ্ধান্ত তারই ইঙ্গিত দেয়।’ এদিকে মার্চে যুক্তরাষ্ট্রে মোট মুদ্রাস্ফীতি কমে ২.৪ শতাংশে নেমে এলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরে তা আবার ৪ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান জেরোম পাওয়েল সতর্ক করে বলেছেন, শুল্ক আরোপ করলে মুদ্রাস্ফীতির হার আবার বাড়তেই পারে। বর্তমানে ট্রাম্প কিছুটা নমনীয় হয়ে শুল্কনীতি পরিবর্তন করলেও গড়পড়তা হিসেবে এখনো আমেরিকানরা ২৮ শতাংশ শুল্কের চাপের মুখে, যা ১৯০১ সালের পর সর্বোচ্চ। ইয়েল বাজেট ল্যাবের গবেষণা বলছে, এই নতুন শুল্কনীতির ফলে প্রতিটি মার্কিন পরিবার গড়ে প্রায় চার হাজার ৯০০ ডলার (প্রায় ছয় লাখ টাকা) ক্ষতির মুখে পড়বে। বিশেষত জামাকাপড়, জুতা ও ইলেকট্রনিক পণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি বাড়বে। একটি গবেষণায় দেখা যায়, ট্রাম্প ২০১৮ সালে ওয়াশিং মেশিনের ওপর ১০ থেকে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলে শুধু ওয়াশার নয়, সঙ্গে ড্রায়ারগুলোর দামও বেড়ে যায়, যদিও সেগুলোর ওপর সরাসরি শুল্ক ছিল না। এই ঘটনাই দেখিয়ে দেয় কীভাবে শুল্ক আরোপের ফলে সামগ্রিকভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসলে ভোক্তাদের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যুক্তরাষ্ট্রে এখন মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে মানুষের প্রত্যাশাও দলীয়ভাবে বিভক্ত। সব মিলিয়ে গড় প্রত্যাশা দাঁড়িয়েছে ৬.৭ শতাংশে, যা ১৯৮১ সালের পর সর্বোচ্চ।

মার্থা গিম্বেল, বাজেট ল্যাবের সহপ্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘মানুষ মাঠের বাস্তবতা না দেখে যেটা শুনছে সেটাকেই বিশ্বাস করছে।’ এই কথাটি অর্থনীতির এক গভীর দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। বাস্তব পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, বাজারে দাম বাড়বে, এই প্রত্যাশাটাই যদি মানুষের মধ্যে গেঁথে যায়, তবে তা বাস্তবতাকেও পেছনে ফেলে সামনে চলে আসে। ট্রাম্পের শুল্কনীতিকে কেন্দ্র করে এখন যেমনটা দেখা যাচ্ছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫