চীনের ‘টিকটক’ অস্ত্রে কাবু মার্কিন বিলাসবহুল ব্র্যান্ড

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৫:৩৮
-680dfb0022c84.jpg)
চীনের টিকটক ইনফ্লুয়েন্সাররা বলছেন, মার্কিনিরা তাদের থেকে সরাসরি বিলাসবহুল পন্য কিনতে পারবেন
চীন থেকে আসা পন্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে বড় আকারে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর এই যুদ্ধে বিজয়ী হতে যত ধরনের অস্ত্র আছে সবই প্রয়োগ করছে ড্রাগনের দেশ। সেক্ষেত্রে টিকটক যে বাণিজ্য যুদ্ধের অস্ত্র হতে পারে- তা চীন প্রয়োগের আগে হয়ত কেউ ভাবেওনি।
সিএনএন বলছে, অথচ বাণিজ্যযুদ্ধের এই অপ্রচলিত অস্ত্রে এরই মধ্যে ঘায়েল হতে শুরু করেছে মার্কিন বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলো।
লুই ভিটন, হারমেস, গুচি, আরমানি, প্রাডা, ব্রুবেরির মতো মার্কিন এই ব্র্যান্ডগুলোকে কাবু করতে খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছে না চীনের পন্য উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
তারা টিকটকে ছোটো ছোটো ভিডিও প্রকাশ করে পন্যের উৎপাদন খরচ দেখিয়ে দিচ্ছে। এতেই কাজ হচ্ছে। ফেসবুক, এক্সের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যার অধিকাংশই ব্র্যান্ডগুলোর সমালোচনা করে।
হারমেস বারকিনির একটি ব্যাগের মূল্য ২৫ হাজার ডলার। অর্থ্যাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৩০ লাখ টাকারও বেশি। চীনের সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা বলছেন, অথচ এর উৎপাদন খরচ ১৮০ ডলার।
গুচি বেল্ট যেখানে মার্কিন বাজারে ৭০০ ডলার দাম, সেখানে উৎপাদন খরচ ২৫ ডলার। ৪০০ ডলারের গুচি টিশার্টের উৎপাদন খরচ মাত্র ২০ ডলার।
৪০০ ডলারের গুচি টিশার্টের উৎপাদন খরচ মাত্র ২০ ডলার
ওয়াং সেন নামের এক টিকটক ব্যবহারকারী দাবি করেছেন- যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের পণ্যগুলোর প্রস্তুতকারক তিনি। এক ভিডিওতে তিনি বলেন, “কেন আপনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিনছেন না? আপনাকে যে দামে পন্য দেব- তা আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না।”
ভিডিওগুলোর শিরোনামও এতদিনে গড়ে ওঠা ব্র্যান্ডকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দেওয়ার মতো। সেখানে লেখা হচ্ছে, ‘লাক্সারি পণ্য মানে কী’, ‘একই ফ্যাব্রিক, ১০ গুণ দাম কেন?’, ‘মার্কেটিং আর মিথ তৈরি করে দাম বাড়ানো হয়।’
চীনা টিকটক ইনফ্লুয়েন্সাররা সরাসরি কারখানা থেকেই পন্য কেনার আহ্বান জানাচ্ছেন। তাদের দাবি, শুল্ক সেক্ষেত্রে কোনো প্রভাবই ফেলবে না। আপনি একটি পণ্য যদি দশ ভাগের এক ভাগ দামেই পান। সেক্ষেত্রে শুল্ক আর কী বাধা সৃষ্টি করবে।
ওয়ান সেনের ভিডিওগুলো টুইটার ছাড়িয়ে ফেসবুক ও এক্সের মতো প্ল্যাটফর্মেও ঘোরাঘুরি করছে। সেসব পোস্টে অনেক মার্কিনী বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলোকে প্রতারনা করার দায়েও অভিযুক্ত করেছেন। ক্রেতারা বুঝতে পারছেন- তারা পন্যের জন্য নয়, ব্র্যান্ডের জন্যই বেশি টাকা ব্যয় করছেন। ফলে লুই ভিটন ও গুচির মতো ব্র্যান্ড বিশ্বাসযোগ্যতার ঝুঁকিতে পড়েছে।
বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্টের লাক্সারি মার্কেটে বড় ধস নামতে পারে- যদি এই ট্রেন্ড চলতে থাকে।
দ্য ইকোনমিস্ট এক প্রতিবেদনে বলেছে, “লাক্সারি এখন আর গুনগত মানের বিষয় নয়। এটি কেবল ধারণার বিষয়। আর চীন সেই ধারণাকে পদ্ধতিগতভাবে ভেঙে দিচ্ছে।”
এরই মধ্যে চীনা কারখানাগুলোতে প্রচুর বিলাসবহুল পন্য জমা হয়ে রয়েছে। ট্রাম্পের ২৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘটনায় কোম্পানিগুলো সেগুলো নিয়ে যাচ্ছে না। অনেক অর্ডারও বাতিল করা হয়েছে। সেগুলো নিয়েই বিপাকে পড়েছে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে বিকল্পও বের হয়ে গেছে।
চীনের নির্মাতারা সরাসরি নির্ভরযোগ্য টিকটক অ্যাকাউন্ট থেকে পণ্য কিনতে উৎসাহিত করছেন। যার ফলে শুল্ক আরোপের পরেও অনেক কম দামে ব্র্যান্ডের পণ্য পাওয়া যাবে।
এমনকি চীনে আলিবাবার মতো অনলাইন কেনাবেচার প্ল্যাটফর্মে ১০ হাজার ডলারের স্যুট পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১০০ ডলারে। ফারাক কেবল ব্র্যান্ডে। অরিজিনাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার (ওইএম) নামের নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। যেখানে বিলাসবহুল পণ্যগুলো ব্র্যান্ডনেম ছাড়া বিক্রি হচ্ছে।
তবে বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বস বলছে, শুধু উৎপাদন খরচ দিয়ে প্রাইজিং মডেল ব্যাখা করার সুযোগ নেই। সেখানে আরএন্ডডি, ব্র্যান্ড ইকুইটি, ডিজাইন, ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক এইগুলোও বড় ফ্যাক্টর।
যেমন চীনের অনেক অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সার দাবি করছেন, আইফোনের উৎপাদন খরচ ১০০ ডলারেরও কম, কিন্তু মডেল ভেদে তা বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে দেড় হাজার ডলারের মধ্যে। গ্যাজেট রিভিউয়াররা এটিকে শ্রেফ অপপ্রচার হিসেবেই বলছেন।
আইফোনের সবচেয়ে বেশি খরুচে জায়গাটি তার অপারেটিং সিস্টেম ও চিপে। যার সঙ্গে চীনের উৎপাদন খরচের কোনো সম্পর্ক নেই। রিসার্চ অ্যাণ্ড ডেভেলপমেন্ট (আরএন্ডডি), সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও লাইসেন্সিং ফিতে অনেক টাকা খরচ করতে হয় অ্যাপলকে।
আইফোনের উৎপাদন খরচ সংক্রান্ত গুজবও বিশ্বাস করছেন নেটিজেনদের কেউ কেউ
হোল সেল ইলেকট্রনিক্স রিভিউ বলছে- সবমিলিয়ে বিবেচনা করলে বাজারে আসা আইফোন ১৬ প্রো ম্যাক্সের উৎপাদন খরচ ৪৮৫ ডলার। এর আগে আইফোন ১৫ প্রো ম্যাক্সের উৎপাদন খরচ ছিল ৫৫৮ ডলার ও আইফোন ১৪ প্রো ম্যাক্সের উৎপাদন খরচ ছিল ৪৬৪ ডলার।
এ ছাড়া আইফোনের দামও সাধারণত দেড় হাজার ডলার হয় না।
এরপরেও এধরণের গুজব নেটিজেনদের অনেকেই গুরুত্ব নিয়ে দেখছেন। বিশ্বাস করছেন। ফলে মার্কিন প্রযুক্তি ব্র্যান্ডগুলোও তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতেই বাজারে এর প্রভাব পড়তে পারে। সবমিলিয়ে গুজব হোক বা সত্য -মার্কিন ব্র্যান্ডগুলো টিকটক অস্ত্রে যে ঘায়েল হচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।