
ফাইল ছবি
১৯৭৬ সালের শুরুর দিকের ঘটনা, আর্জেন্টিনায় তখন সামরিক জান্তা জর্জ রাফায়েল ভিদেলার শাসন চলছে। চারদিকে বিরাজ করছিল অস্থিরতা, সেই সঙ্গে জনগণের মাঝে চাপা ক্ষোভ আর আতঙ্ক। এর মাঝেই বাস ভাড়া বাড়িয়ে দেয় সরকার। এ ঘটনার প্রতিবাদে এবং ‘স্টুডেন্ট পাস’-এর দাবিতে বুয়েনস এইরেস প্রদেশের রাজধানী লা প্লাতায় ‘ইউনিয়ন অব হাই স্কুল স্টুডেন্টস’ আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে ব্যাপক সাড়া দেয়। আন্দোলন দমাতে সরকার পুলিশ নামায়। শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিপেটা করে পুলিশ। তবুও শিক্ষার্থীরা দমে যায়নি। তারা আন্দোলন চালিয়ে যায়। এক পর্যায়ে সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়।
ঘটনা এখানে শেষ হলেই ভালো হতো। কিন্তু তা হয়নি। সামরিক জান্তা ভিদেলা ক্ষমতা গ্রহণের পর নির্দয়ভাবে সব ধরনের বিরোধী মত দমনে তৎপর হয়ে ওঠেন। বামপন্থি গেরিলা দমনের নামে আটক করে নিয়ে যাওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। যাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, তাদের ওপর চলত অমানুষিক নির্যাতন। খুন ও ধর্ষণের মতো ভয়াবহ নির্মমতারও শিকার হন বন্দিরা। গুম করে ফেলা হয় অসংখ্য মানুষকে।
দমন-পীড়নের সে ঝড় এসে পড়ল ‘হাফ পাসের’ দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর। ১৯৭৬ সালের ৮ থেকে ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ১০ শিক্ষার্থীকে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর একদল মুখোশ পরা সদস্য বিভিন্ন স্থান থেকে তুলে নিয়ে যান। অপহরণের শিকার ১০ জন- মারিয়া ক্লারা, মারিয়া ক্লডিয়া ফ্যালকন, এমিলি মোলার, প্যাট্রিশিয়া মিরান্ডা, ক্লডিও ডি আচা, গুস্তাভো কালোত্তি, পাবলো দিয়াজ, হোরাসিও উনগারো, ড্যানিয়েল এ রোচেরো ও ফ্রান্সিসকো লোপেজ মুনটানের। এই শিক্ষার্থীদের বয়স ছিল ১৬ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। আটকের পর তাদের আরানা নামের একটি জায়গায় গোপন সেলে বন্দি রাখা হয়। খেতে না দেওয়া, নানা পন্থার দৈহিক নির্যাতন, ইলেকট্রিক শক ও ধর্ষণ- সব কিছুরই মুখোমুখি হয় তারা।
১৯৮৩ সালে সামরিক শাসনের অবসানের পর গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় বসলে খোঁজ পাওয়া যায় এই শিক্ষার্থীদের। অপহৃত ১০ শিক্ষার্থীর মধ্যে পাবলো দিয়াজ, গুস্তাভো কালোত্তি, এমিলি মোলার ও প্যাট্রিসিয়া ছাড়া পান। অনেক পরে জানা যায়, ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে বাকিদের ফায়ারিং স্কোয়াডে মেরে ফেলা হয়েছিল। সামরিক জান্তা রাফায়েল ভিদেলা এবং তার হয়ে গুম-খুনে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের যখন আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়, ১৯৮৫ সালে আদালতে সাক্ষ্য দিতে উপস্থিত হন পাবলো দিয়াজ। সেখানে পাবলো দুঃসহ সেই দিনগুলোর বর্ণনা দিলে সারা বিশ্ব তা জানতে পারে।
বেঁচে ফিরে আসা এমিলি মোলার এক হৃদয়বিদারক উক্তি করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি এমন কিছু করিনি, যার জন্য আমাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। আর ওরাও এমন কিছু করেনি, যে কারণে ওদের মেরে ফেলা হলো।’
বিচারে সামরিক জান্তা ভিদেলার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয় এবং ১৯৯০ সালে তিনি ছাড়া পান। তার সহযোগীদের অনেকেরই সাজা হয়। বেশির ভাগের হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ২০১০ সালের ২ জুলাই ভিদেলা আবারও বিচারের মুখোমুখি হন। ২২ ডিসেম্বরের রায়ে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ২০১২ সালে আরেকটি অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার ৫০ বছরের কারাদণ্ড হয়। ২০১৩ সালের ১৭ মে মার্কোস পাজ কারাগারে ঘুমের মধ্যে মৃত্যু হয় সামরিক জান্তা রাফায়েল ভিদেলার।
১০ শিক্ষার্থীকে অপহরণ, নির্যাতন ও গুমের ঘটনায় প্রতি বছর ১৬ সেপ্টেম্বর আর্জেন্টিনায় ‘নাইট অব দ্য পেনসিলস’ দিবসটি পালন করা হয়। ১৯৮৬ সালে এ ঘটনার ওপর ভিত্তি করে হেক্টর অলিভিয়েরা একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। সিনেমাটির নামও ‘নাইট অব দ্য পেনসিলস’! মুক্তির পর সিনেমাটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। আজও এ সিনেমা মানুষের মনে রেখাপাত করে। এত এত বিচারপ্রক্রিয়ার পরও যে প্রশ্নটির উত্তর আজও মেলেনি- ‘কেন তাদের মেরে ফেলা হলো?’