ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে আতঙ্ক, পাকিস্তানি কাশ্মীরিরা ‘যুদ্ধ প্রস্তুতিতে’

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৫, ১৩:১৬

ভারতীয় পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার জেরে কাশ্মীর সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হতে পারে—এমন আশঙ্কায় আজাদ কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী গ্রামবাসীদের দুই মাসের খাবার, পানি ও ওষুধ মজুত করে রাখার নির্দেশ দিয়েছে পাকিস্তান।
নেটিজেনদের অনেকেই বলছেন, দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও সর্বাত্মক যুদ্ধের শঙ্কা খুব ক্ষীণ। তবে এরই মধ্যে একাধিক যুদ্ধ দেখে ফেলা দুইদেশের অধিকৃত কাশ্মীরের বাসিন্দাদের কাছে যুদ্ধ যেন এক বাস্তব বিষয়। যা যে কোনো মুহূর্তেই শুরু হতে পারে।
রয়টার্সে শুক্রবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরজুড়ে বাঙ্কার খোঁড়া, রসদ জোগাড় এবং জরুরি প্রস্তুতি নেওয়ার কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সীমান্তের ওপারে, ভারতীয় অংশেও আতঙ্ক বিরাজ করছে—যুদ্ধের প্রহর যেন গোনা শুরু হয়ে গেছে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের চুরান্ডা গ্রামের শিশুরা প্রতিদিনের মতোই স্কুলে আসে। তবে শিক্ষক ফারুক আহমদ রয়টার্সকে বলেন, “অভিভাবকদের মধ্যে ভয় চরম পর্যায়ে।” তিনি আরও জানান, উভয় পাশে মানুষজন আশঙ্কা করছেন- পেহেলগামের বন্দুকধারীর হামলা হয়তো নতুন করে সংঘর্ষ ডেকে আনবে।
কিন্তু সেই অর্থে ভারতীয় কাশ্মীরিদের যুদ্ধের জন্য কোনো প্রস্তুতি নিতে দেখা যাচ্ছে না। সরকারি কোনো সহায়তা প্রাপ্তির তথ্যও মেলেনি। যদিও স্থানীয় সূত্র বলছে, সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করেই যাচ্ছে ভারত।
ভারত ও পাকিস্তান এরই মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে দুটি যুদ্ধ করেছে এবং কয়েক দশক ধরেই সীমান্তে অসংখ্য সংঘর্ষ হয়ে আসছে। তাই এই অঞ্চলের মানুষ প্রতিবেশী দুই দেশের মাঝে উত্তেজনা বাড়লেই দুশ্চিন্তায় অপেক্ষায় থাকে—তাদের জীবনে এটি নতুন নয়।
গত সপ্তাহে একটি পাহাড়ি সৌন্দর্যপূর্ণ এলাকায় সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীরা অন্তত ২৬ জন পর্যটককে হত্যা করে। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করলেও পাকিস্তান তা অস্বীকার করেছে। ইসলামাবাদ বলছে, তাদের কাছে ‘বিশ্বস্ত গোয়েন্দা তথ্য’ রয়েছে যে, ভারত শীঘ্রই সামরিক অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে।
চুরান্ডা গ্রাম থেকে উভয় পক্ষের সেনাদের পোস্ট চোখে পড়ে। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা জানান, গত কয়েক বছরে- এখানে গোলাগুলিতে অন্তত ১৮ জন নিহত হয়েছেন।
২৫ বছর বয়সী আবদুল আজিজ বলেন, “১৫০০ জন মানুষের এই গ্রামে মাত্র ৬টি বাঙ্কার আছে। দুই দিক থেকেই হুমকি আসছে। যদি সীমান্তে বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়, তবে আমরা কোথায় যাব? ভয় তো আছেই—এই গ্রামটাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
ভারতের অংশে আতঙ্ক থাকলেও পাকিস্তানের অংশের মানুষগুলো তুলনামূলক অনেক নির্ভার।
রয়টার্স জানিয়েছে, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের চাকোথি গ্রামে মানুষজন তাদের ঘরের পাশে পাহাড়ের ঢালে শক্তপোক্ত আশ্রয়স্থল তৈরি করছে।
২২ বছর বয়সী ফয়জান আনায়াত রাওয়ালপিন্ডি শহরে এসি টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন। পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে সম্প্রতি কাশ্মীরে এসেছেন। তিনি বলেন, “মানুষ তাদের বাড়িতেই বাঙ্কার তৈরি করেছে। যখনই গুলি চালানো হয়, সবাই বাঙ্কারে চলে যায়।”
তার এক প্রতিবেশী, ৭৩ বছর বয়সী মোহাম্মদ নাজির- বাঙ্কার প্রস্তুতির মাঝেই জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যান। আর তার পরিবারের শিশুরা সেই বাঙ্কারের সামনে ক্রিকেট খেলে। নাজির বলেন, “আমরা কিছুতেই ভয় পাই না। আমাদের প্রতিটি সন্তান প্রস্তুত রয়েছে।”
পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, তারা একশ কোটি পাকিস্তানি রুপি (৩৫ লাখ ডলার) বরাদ্দ দিয়েছে এবং সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে দুই মাসের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য, পানি ও চিকিৎসাসামগ্রী পাঠিয়েছে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভারতীয় হামলার আশঙ্কায় তারা অঞ্চলটির সব ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১০ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে।
তারা নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে অবকাঠামোগত ক্ষতি মেরামতের সরঞ্জাম স্থানান্তর করেছে এবং উদ্ধার ও সিভিল ডিফেন্স সংস্থাগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে—এমন তথ্য দিয়েছে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের প্রিমিয়ার কার্যালয়।
পাকিস্তান রেড ক্রিসেন্টের কাশ্মীর শাখার প্রধান গুলজার ফাতিমা জানান, তারা পরিস্থিতির উত্তেজনা বাড়তে দেখেই ত্রাণ সামগ্রী ও কর্মী প্রস্তুত করতে শুরু করেন, যার মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাদানকারী দল।
তিনি বলেন, “যদি ভারতীয় সেনাবাহিনী অভিযান চালায়, তাহলে সীমান্ত এলাকা থেকে ব্যাপকসংখ্যক মানুষ স্থানচ্যুত হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য অন্তত ৫০০ পরিবারের জন্য তাঁবু, স্বাস্থ্যসামগ্রী ও রান্নার সরঞ্জামসহ ত্রাণ শিবির প্রস্তুত রাখা হচ্ছে।”
ভারতের দিকেও মানুষ উদ্বিগ্ন। চুরান্ডার আরেক শিক্ষক বলেন, “এটা যেন নিঃশ্বাস আটকে রাখার মতো পরিস্থিতি। গোলাগুলি শুরু হলে স্কুল, ঘরবাড়ি—সবকিছুই অনিরাপদ হয়ে যাবে।”