ঊর্ধ্বমুখী সোনার বাজার নতুন অর্থনৈতিক ফাঁদে উন্নয়নশীল বিশ্ব

তৌসিফ আহমেদ
প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৫, ১১:১৪

সোনার দাম বেড়েই চলেছে। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ববাজারে সোনার দাম বেড়েই চলেছে। এ বছরের এপ্রিল মাসে এসে প্রতি আউন্স সোনার দাম পৌঁছেছে তিন হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারের ঘরে, যা বছরের শুরু থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। রেকর্ডের পর রেকর্ড ভাঙা এই দামের পেছনে রয়েছে একাধিক বৈশ্বিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক নীতিমালায় অনিশ্চয়তা, ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হারসংক্রান্ত দ্বিধা এবং বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে পরিচিত সোনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সম্প্রতি মার্কিন ডলারের মান কমে যাওয়ায় সোনা আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক বাজারে। একদিকে বিনিয়োগকারীরা ডলার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, অন্যদিকে সোনায় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন।
চীন, ভারত, তুরস্কসহ একাধিক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোনা কিনে রিজার্ভে বৈচিত্র্য আনতে চাইছে, যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে দাম বৃদ্ধিতে। এর পাশাপাশি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনা, ইসরায়েল-ইরান পরিস্থিতি ও সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান টানাপোড়েন বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করে তুলেছে। এসব কারণে ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারবাজার বা মুদ্রা বাজারের পরিবর্তে সোনার মতো নিরাপদ সম্পদের প্রতি তাদের আগ্রহ ক্রমাগত বাড়ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এই দাম বৃদ্ধির প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে কেমন পড়ছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঊর্ধ্বগতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি বড় চাপ। বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানের মতো দেশগুলো এখন সোনার আমদানি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাধ্য হচ্ছে। এরা নিজেরা সোনা উৎপাদন না করায় বাইরের বাজার থেকে সোনা আমদানি করতেই হয়। এই আমদানি করতে গিয়ে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে। প্রতি আউন্স সোনার দাম যখন দ্রুত বাড়তে থাকে, তখন সেই মুদ্রা ব্যয়ও বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এতে স্বাভাবিকভাবেই চাপ পড়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে, যার প্রভাব পড়ছে তাদের মুদ্রার মান ও মুদ্রাস্ফীতিতে। আর এই ঊর্ধ্বমুখী সোনার বাজার উন্নয়নশীল দেশের জন্য এক ধরনের অর্থনৈতিক ফাঁদ তৈরি করছে। এসব দেশের পুঁজি সীমিত, বৈদেশিক রিজার্ভ দুর্বল আর জনগণের অর্থনৈতিক সহ্যক্ষমতা সীমিত। ফলে সোনার দাম বৃদ্ধি মানেই তাদের জন্য বহুমুখী আর্থিক চাপ। মুদ্রার মান কমে গেলে বিদেশ থেকে ঋণ পরিশোধেও বাড়তি ব্যয় যোগ হয়, ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা।
অন্যদিকে বিনিয়োগের ধারা পরিবর্তিত হচ্ছে। যারা আগে শেয়ারবাজার বা সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করতেন, তারা এখন সোনা বা ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো বিকল্প সম্পদের দিকে ঝুঁকছেন। এতে করে ঐতিহ্যবাহী আর্থিক বাজারগুলোতে তারল্য সংকটের আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে।
সোনার দাম বাড়ার আরেকটি ফল হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা। এই পরিস্থিতিতে যেসব দেশ আগে থেকেই উচ্চমাত্রায় ডলার-নির্ভর, তাদের আমদানি ব্যয় আরো বেড়ে যাচ্ছে এবং এই চাপ দীর্ঘ মেয়াদে মূল্যস্ফীতিকে আরো জটিল করে তুলছে। এ ছাড়া বাণিজ্যে নতুন মুদ্রা বা সম্পদ ব্যবহারের প্রবণতা তৈরি হওয়ায় আন্তর্জাতিক আর্থিক নীতি এবং চুক্তিগুলোতেও নতুন করে আলোচনা দরকার হয়ে পড়ছে। অনেকে বলছেন, এটি বিশ^ব্যাপী এক নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতার ইঙ্গিত দিচ্ছে; যেখানে শুধু ডলার নয়, সোনাও ভবিষ্যৎ বাণিজ্য ও রিজার্ভের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্লেষকদের অনেকে পূর্বাভাস দিচ্ছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে সোনার দাম চার হাজার ডলারের ঘর ছুঁয়ে ফেলতে পারে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা যদি প্রশমিত না হয়, তবে সোনার উত্থান সাময়িক নয়, বরং এটি হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি এক নতুন বাস্তবতা। বিশ্বমুদ্রা ও বিনিয়োগ বাজারের গতিপথ বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখনকার সময়টাকে safe haven shift’ বলা যায়। অর্থাৎ ঝুঁকির সময় মানুষ যেখানে আশ্রয় নেয়, সেই জায়গাগুলোতে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ফলে সোনার ওপর নির্ভরশীলতা যেমন বাড়ছে, তেমনি বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্যেও দেখা দিচ্ছে নতুন টানাপোড়েন।
বিশ্বব্যবস্থার আরেকটি আশঙ্কার দিক হচ্ছে সোনার চড়া দাম মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির জন্য সোনাকে আরো দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মতো অঞ্চলে বিয়ে বা সামাজিক রীতিতে সোনার গুরুত্ব অনেক। কিন্তু এখন এই মূল্যবৃদ্ধি সেই চাহিদাকে কঠিন করে তুলছে। এতে করে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। একই সঙ্গে যারা আগে সোনা গয়না হিসেবে কিনতেন, তারা এখন তা এক ধরনের বিনিয়োগ হিসেবেই ভাবছেন। ফলে স্বর্ণ ব্যবসার চরিত্রও বদলে যাচ্ছে। আর এই পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী হলে বিশ্বজুড়ে সোনার বাজারে এক নতুন কাঠামো গড়ে উঠবে, যার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিণতি হতে পারে বহুমাত্রিক।