Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

চিকিৎসা শেষে শিশুদের ফের যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ফেরত পাঠাচ্ছে জর্ডান

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ মে ২০২৫, ১৫:৩৬

চিকিৎসা শেষে শিশুদের ফের যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ফেরত পাঠাচ্ছে জর্ডান

সাত মাস বয়স নিভীন, জন্মেছে গাজা যুদ্ধের মধ্যে—হৃদপিণ্ডে একটি ছিদ্র নিয়ে।

গাজা উপত্যকার উত্তরের আল-শাতি শরণার্থী শিবিরের একটি অস্থায়ী তাঁবুতে ছোট্ট নিভীনকে কোলে নিয়ে বসে আছেন মা ইনাস আবু ডাক্কা। শিশুটির পেছনে গুনগুন শব্দে একটি ফ্যান চলছে।


ইনাস উদ্বিগ্ন—নিভীনের স্বাস্থ্য যে কোনো মুহূর্তে খারাপের দিকে যেতে পারে। মাত্র সাত মাস বয়স নিভীনের, সে জন্মেছে যুদ্ধের মধ্যে—হৃদপিণ্ডে একটি ছিদ্র নিয়ে।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির সাথে কথা বলার সময় মায়ের চোখে-কণ্ঠে ভেসে ওঠে অসহায়ত্ব। তিনি ব্যাখ্যা করেন কীভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভেতরেও তিনি মেয়েটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। নিভীন তার বড় বড় বাদামি চোখ আর ক্ষীণ দেহ নিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর ছটফট করছে।

“যুদ্ধটা ওর জন্য খুব কঠিন হয়েছে,” বিবিসিকে বলেন ইনাস। “ওর ওজন বাড়ছিল না কিছুতেই, আর খুব সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়ত।”

নিভীনের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় ছিল গাজার বাইরে তৎপর ও জরুরি চিকিৎসা পাওয়া। আর সেটা সম্ভব হয় মার্চের শুরুতে, যখন জর্ডান সাহায্যের হাত বাড়ায়।

সেসময় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর ছিল। সেই সুযোগে নিভীনসহ ২৯ জন অসুস্থ গাজাবাসী শিশুকে জর্ডানে চিকিৎসার জন্য সরিয়ে নেওয়া হয়। নিভীনের মা ও বড় বোনও তার সঙ্গে যেতে পারেন।

জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহর ঘোষণার পর তারা ছিল প্রথম দলে, যাদের জর্ডানে চিকিৎসার জন্য সরিয়ে নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে বাদশাহ আব্দুল্লাহ জানিয়েছিলেন, জর্ডান ২,০০০ গাজাবাসী শিশুকে নিজ দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা দেবে। এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে করা হয়।

জর্ডানের চিকিৎসকরা নিভীনের ওপরে ওপেন-হার্ট সার্জারি সফলভাবে সম্পন্ন করেন। ধীরে ধীরে সুস্থ হতে শুরু করে নিভীন।

কিন্তু শিশুদের চিকিৎসা চলার প্রায় দুই সপ্তাহ পর যুদ্ধবিরতি ভেঙে যায়। ইসরায়েল আবার হামাসের ওপর আক্রমণ শুরু করে। পূর্ণমাত্রায় আবার শুরু হয় যুদ্ধ।

হাসপাতালের ঘরে বসে নিজের মেয়ের শুশ্রূষার মাঝেই ইনাস খবরের পর খবর দেখে যাচ্ছিলেন। গাজার ভেতরে থাকা স্বামী আর অন্য সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিদিন উৎকণ্ঠায় দিন কাটছিল।

এরপর ১২ মে গভীর রাতে জর্ডানের কর্তৃপক্ষ ইনাসকে জানায়—তাদের পরিবারকে পরদিনই গাজা ফেরত পাঠানো হবে। কারণ, তাদের মতে, নিভীনের চিকিৎসা শেষ।

এই খবরে হতবাক হয়ে যান ইনাস।

“আমরা এসেছিলাম যুদ্ধবিরতির সময়। আবার যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর কীভাবে আমাদের ফেরত পাঠায়?”—ক্ষোভে ফেটে পড়েন ইনাস।

গাজায় ফিরে এখন স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে আছেন ইনাস আবু ডাক্কা। কিন্তু তার দাবি, সাত মাসের মেয়ে নিভীনের চিকিৎসা পুরোপুরি শেষ হয়নি। ফলে যেকোনো সময় শিশুটির শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে পারে।

“আমার মেয়ের অবস্থা খুব খারাপ। তার হার্টের সমস্যা রয়েছে,” বলছিলেন ইনাস। “অনেক সময় দম বন্ধ হয়ে আসে, নীল হয়ে যায়। তাঁবুতে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।”

১৩ মে জর্ডান ১৭ শিশুকে চিকিৎসা শেষে গাজায় ফেরত পাঠায়। এর পরদিন আরও চারজন শিশুকে গাজা থেকে সরিয়ে জর্ডানে নেওয়া হয়।

জর্ডান সরকার বিবিসিকে জানিয়েছে, যেসব শিশুকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা ‘ভাল অবস্থায়’ ছিল। তাদের চিকিৎসা সম্পন্ন হয়েছে—এ দাবিও করেছে তারা।

সরকারি এক বিবৃতিতে বলা হয়, জর্ডান শুরু থেকেই পরিষ্কার করে বলেছিল—চিকিৎসা শেষে শিশুদের ফেরত পাঠানো হবে। এর পেছনে রাজনৈতিক ও ‘লজিস্টিক’ কারণ রয়েছে।

আরও বলা হয়, ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমিতে রাখাই জর্ডানের নীতিগত অবস্থান; তাদের বাইরে সরিয়ে নেওয়ার পক্ষপাতী নয় তারা। ১৭ জনকে ফেরত পাঠানোয় অন্য অসুস্থ শিশুদের জন্য জায়গা তৈরি হয়েছে।

তবে গাজার হামাস-শাসিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, ওই শিশুরা এখনও অসুস্থ, এবং তাদের যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় ফেরত পাঠানোয় জীবন ঝুঁকিতে পড়েছে।

‘জোর করে ফেরত পাঠানো হয়েছে’

এ বিষয়টি নিয়েই উদ্বিগ্ন ৩০ বছর বয়সী নিহায়া বাসেল।

তার এক বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদ হাঁপানি ও খাদ্য অ্যালার্জিতে ভুগছে। তার মতে, সন্তানের যথাযথ চিকিৎসা হয়নি।

“ভয় আর ক্ষুধার মধ্যে আছি আবার, চারদিকে শুধু মৃত্যু,” বললেন নিহায়া, চোখে জল নিয়ে। “ছেলেটার জন্য দুধ কোথায় পাব? কিছু খেতেই পারে না। খেলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে।”

ইসরায়েল গত ১১ সপ্তাহ ধরে গাজার উপর অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। খাবার, ওষুধ, আশ্রয়, এমনকি জ্বালানিও আটকে রেখেছে।

তারা বলছে, গাজায় যেসব জিম্মি রয়েছে—তাদের মুক্তি আদায়ে চাপ তৈরির কৌশল এটি।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, গাজায় ‘চরম দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি’ তৈরি হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে ইসরায়েল গত সোমবার ‘স্বল্প পরিমাণ’ খাদ্য ঢুকতে দিয়েছে। পাঁচটি ট্রাকে করে কিছু বেবি ফুড ঢুকেছে বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে, যদিও এটিকে তারা বলছে ‘মরুভূমিতে এক ফোঁটা শিশির’।

নিহায়া এখন আল-শাতি শিবিরে তার ভাসুরের পরিবারের সঙ্গে একটি তাঁবুতে আছেন। যুদ্ধ শুরু হলে তার স্বামী ও অন্য তিন সন্তান উত্তরের অন্য অঞ্চল থেকে পালিয়ে এখানে আসেন।

“আমার স্বামী, সন্তান—সবাইকে রেখে গিয়েছিলাম। তারা ভয়ংকর সময় পার করেছে,” বলছিলেন নিহায়া, কান্নায় ভেঙে পড়ে।

“সন্তানের চিকিৎসার জন্য সব কিছু ছেড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু চিকিৎসা শেষ না হতেই কেন ফিরিয়ে আনল?”

বলেন, যখন কথা বলছিলেন, তখন তাঁর গলার স্বর ঢেকে দিচ্ছিল ইসরায়েলি ড্রোনের একটানা গোঁজ গোঁজ শব্দ। ছোট্ট মোহাম্মদ তাঁবুর মধ্যে খেলতে খেলতে প্রায় আগুনের চুলায় পড়ে যাচ্ছিল।

নিহায়া বলেন, জর্ডান থেকে ফিরতি পথে তার অভিজ্ঞতাও সুখকর ছিল না।

“ভোর ৪টায় রওনা দিয়ে রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে গাজায় পৌঁছাই। সীমান্তে ইসরায়েলি বাহিনী আমাদের হেনস্তা করে। গালাগাল করে, মারধরের হুমকি দেয়। আমাদের টাকা, মোবাইল, ব্যাগ—সব নিয়ে নেয়।”

ইনাসও একই অভিযোগ করেছেন। জানান, তার ওষুধও নিয়ে গেছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, গাজাবাসীদের কাছ থেকে যে ‘অতিরিক্ত নগদ অর্থ’ পাওয়া গেছে, তা তারা জব্দ করেছে, কারণ তাদের সন্দেহ—এই অর্থ গাজায় সন্ত্রাসে ব্যবহৃত হতে পারে।

তবে মোবাইল বা অন্যান্য জিনিসপত্র কেন নেওয়া হয়েছে, তার ব্যাখ্যা দেয়নি তারা।

নিহায়া বলেন, “আমি খালি হাতে ফিরেছি। এমনকি ছেলের চিকিৎসার কাগজপত্রও ওরা রেখে দিয়েছে।”

জর্ডান বলছে, নিভীন ও মোহাম্মদের মতো শিশুদের তারা সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিয়েছে।

দুই পরিবারও তা স্বীকার করেছে। কিন্তু তাদের ভয়—যুদ্ধের মাঝে জীবনযাপন এই দুই মাসের উন্নতিটুকু মুছে দেবে।

“ছেলেকে এমন অবস্থায় দেখেছিলাম, খুব খুশি হয়েছিলাম,” বললেন নিহায়া, আবার চোখ ভিজে উঠল। “এখন আবার শুরু থেকে শুরু? আমি চাই না আমার সন্তান মারা যাক।”





Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫