যুদ্ধ ছাড়াই ‘ফিল্ড মার্শাল’ পাকিস্তানের সেনাপ্রধান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২১ মে ২০২৫, ১৫:৫৩
-682da298087e4.jpg)
পাকিস্তানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই কটাক্ষ করে এ ধরনের ছবি তৈরি করছেন। যেখানে দেখা যাচ্ছে, সেনাপ্রধান নিজেকে নিজেই পদক পড়িয়ে দিচ্ছেন।
যুদ্ধের ময়দানে বিজয়ের গৌরব নিয়ে যেসব সেনানায়ক ইতিহাসে স্থান করে নেন, তারাই ফিল্ড মার্শাল খেতাব পান। আর তাদের একজন হয়ে ওঠার পথ কখনোই সহজ নয়।
যদিও এবার ব্যতিক্রম দেখা গেছে। ডনের প্রতিবেদনে মঙ্গলবার জানানো হয়েছে, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির ‘ফিল্ড মার্শাল’ খেতাবে ভুষিত হয়েছেন।
বড় কোনো যুদ্ধ না করেই তার ফিল্ড মার্শাল হয়ে ওঠা বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে বিরল এবং অনেকের মতে বিতর্কিত ঘটনা।
তবে পাকিস্তানের কাছে এ ঘটনা নতুন নয়।
দেশটির ইতিহাসে এর আগে জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ‘ফিল্ড মার্শাল’ উপাধি পান। তাঁর ক্ষেত্রেও বিতর্ক কম ছিল না।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পটভূমিতে আইয়ুব খান নিজেকে এই খেতাব দেন। যদিও পাকিস্তান দাবি করে, তারা সেই যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিল, বাস্তবতা হলো ভারতই বেশি ভূখণ্ড দখল করেছিল এবং সামগ্রিকভাবে যুদ্ধটি ছিল ফলাফলহীন।
যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা সেই যুদ্ধকে ফলাফলহীন হিসেবেই বিবেচনা করেন। তবুও আইয়ুব খান সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক অবস্থানকে পোক্ত করতে নিজের জন্য এই পদবী বেছে নেন।
বিশ্ব ইতিহাসে ‘ফিল্ড মার্শাল’ খেতাব সাধারণত অসাধারণ সামরিক কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে প্রদান করা হয়ে থাকে। ব্রিটেনের বার্নার্ড মন্টেগোমারি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এল আলামেইনের যুদ্ধে নাৎসি বাহিনীকে পরাস্ত করে এই খেতাব পান।
সোভিয়েত ইউনিয়নের জর্জি ঝুকভ বার্লিন দখলের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, আর জার্মানির এরউইন রোমেল আফ্রিকান ফ্রন্টে তার সাহসী নেতৃত্বের জন্য এই মর্যাদায় ভূষিত হন।
ভারত থেকে এই খেতাব পান ৭১ সালের যুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া স্যাম মানেকশ এবং ভারতের প্রথম সেনাপ্রধান কে এম কারিয়াপ্পা।
আমাদের প্রত্যেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রমাণিত দক্ষতা ও নেতৃত্বের জন্য ‘ফিল্ড মার্শাল’ হন।
এই প্রেক্ষাপটে জেনারেল আসিম মুনিরের পদোন্নতিকে অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ মনে করছেন। কারণ তার মেয়াদকালে পাকিস্তান কোনো পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়ায়নি। যদিও সেনাবাহিনী দাবি করছে, ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক উত্তেজনার সময় তাঁর নেতৃত্বে ‘অপারেশন বুনিয়ান উর মারসুস’ নামে একটি কৌশলগত অভিযান পরিচালিত হয়, যার মাধ্যমে ভারতের কয়েকটি স্থানে সাইবার এবং সীমান্ত চাপে কৌশলগত সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
তবে আন্তর্জাতিক কোনো নিরপেক্ষ সংস্থা এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানায়নি।
পাকিস্তানের নেটিজেনরাই খোদ মনে করছেন, এই পদোন্নতি সম্ভবত সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সরকারের প্রতি প্রভাব খাটানোর একটি প্রতীকী পদক্ষেপ। অনেকেই বিভিন্ন মিম বানিয়ে মজাও করছেন।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক অভ্যুত্থান হোক বা পরবর্তী সময়ে পারভেজ মোশাররফের ক্ষমতা গ্রহণ—প্রতিটি ধাপে সেনাবাহিনীই ছিল মূল চালিকা শক্তি।
তাই এই খেতাব অনেকের কাছে মুনিরকে ভবিষ্যতের ‘রক্ষাকর্তা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। অনেকে বলছেন, এই পদোন্নতি সেনাবাহিনীর মর্যাদা বৃদ্ধি করবে, অন্যদিকে কেউ এটিকে পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসনের অতীত অভ্যাস—নিজেদের গৌরব নিজেরাই নির্ধারণ করার প্রবণতার—আরেকটি দৃষ্টান্ত বলেই মনে করছেন।
আন্তর্জাতিক সামরিক কৌশলবিদদের মতে, ‘ফিল্ড মার্শাল’ কোনো আনুষ্ঠানিক সম্মান নয় বরং এটি যুদ্ধক্ষেত্রে জাতীয় অবদানের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। তাই এই ধরনের মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কৃতিত্ব ও বাস্তব যুদ্ধজয় আবশ্যক।
অন্যথায় এটি সামরিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করতে পারে।
অনেক নেটিজেনই প্রশ্ন তুলেছেন, যদি সামরিক বাহিনীর প্রধান শুধুমাত্র একটি সীমিত উত্তেজনার সময়ে এবং সুনির্দিষ্ট যুদ্ধ ছাড়াই ‘ফিল্ড মার্শাল’ হন, তবে ভবিষ্যতে এই উপাধির মান ও গুরুত্ব কোথায় দাঁড়াবে? এতে কি বাস্তব যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে পাওয়া কৃতিত্বকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে না?
যুদ্ধ ছাড়াই যুদ্ধজয়ের সম্মান পাওয়া কীভাবে ইতিহাসে মূল্যায়িত হবে, তা ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দেওয়া ভালো।
তবে আসিম মুনিরের এই পদোন্নতি নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের গতিপথে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। ফিল্ড মার্শাল খেতাব শুধুই একটি পদ নয়, এটি একটি বার্তা—যা শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্রতিধ্বনি তোলে। এখন দেখার বিষয়, এই প্রতিধ্বনি ইতিহাসে প্রশংসা কুড়ায় নাকি বিতর্কের খোরাক হয়।