ট্রাম্পের এ সফরের উদ্দেশ্য ফিলিস্তিন প্রশ্নকে মুছে ফেলা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫, ১৪:০২

ছবি : এপি। সৌদি যুবরাজ সালমানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প
প্রকাশ্যে একটি গণহত্যায় অস্ত্র জোগান দেন, তখন তাকে লাল গালিচা বিছিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়। আর খুশি রাখতে করা হয় বিলিয়ন ডলারের চুক্তি, সেই সঙ্গে চলে ব্যক্তিগত উপহার আদান-প্রদান। আর অন্যদিকে গাজা জ্বলতেই থাকে। উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলোর বিপুল সম্পদ ও রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেও তাদের ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ।
গাজা দখল, ইসরায়েলি বাহিনীর অবরোধ এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের উদ্যোমী ভূমিকা একেবারেই চোখে পড়ে না, বরং এ নিধনযজ্ঞে তাদের নীরব সমর্থনই স্পষ্ট। এই আনুগত্যের ফলে ট্রাম্প ইসরায়েলকে মারণাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেন, যাতে করে পুরো অঞ্চলকে নিজের ইচ্ছামতো রূপান্তরের যে স্বপ্ন তিনি দেখেন, তা বাস্তবায়ন করতে পারেন।
ট্রাম্পের এই সফরের উদ্দেশ্য স্পষ্ট ফিলিস্তিন প্রশ্নকে মুছে ফেলা। দখলদার ইসরায়েলি রাষ্ট্রকে চিরস্থায়ী এবং মধ্যপ্রাচ্যকে এক ইসরায়েলকেন্দ্রিক নকশায় রূপান্তর করা। ট্রাম্পের চোখে মধ্যপ্রাচ্য কেবলই বাজার, অস্ত্রের গুদাম আর এক ভূ-রাজনৈতিক এটিএম। ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘একটা কঠিন পাড়া’। এই মন্তব্যের মধ্যে নিহিত আছে এক সামরিকীকৃত বিশ্বদৃষ্টি। যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষকে বিবেচনা করা হয় হুমকি হিসেবে, যাদের প্রতি সহানুভূতির দরকার নেই।
২০১৭ সালে সৌদি আরবের সঙ্গে ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তিকে ‘সমৃদ্ধির মাধ্যমে শান্তি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এখন ট্রাম্পের থেকে আরো অনেক বেশি চাইছেন। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, তিনি সৌদি আরবকে তার পুরো জিডিপি ১ ট্রিলিয়ন ডলার মার্কিন অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করতে বলেছেন।
অর্থনীতিবিদদের চোখে এটি পাগলামি হলেও ট্রাম্পের কাছে এটাই ‘চুক্তি’ করদরাজ্যের আনুগত্যের প্রকাশ। প্রথম মেয়াদের মতো এবারও প্রথম দেশ হিসেবে সৌদি সফর করলেন ট্রাম্প।
এই সফরে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সৌদির মোট ৬০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে বলে দাবি করেছে হোয়াইট হাউস, যার মধ্যে আছে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অস্ত্র বিক্রি চুক্তি’। ট্রাম্প সিরিয়ার ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন এই সফরেই।
ব্রিটিশ-তিউনিশার লেখক ও মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির বিশ্লেষক সৌমাইয়া ঘান্নুশি বলেন, ‘‘এই অঞ্চল এখন আর কূটনৈতিক ক্ষেত্র নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক নির্লজ্জ বাণিজ্যিক ভল্ট। সার্বভৌম তহবিলগুলো গণতন্ত্রে ব্যয় না হয়ে বিলাসিতার বন্যায় ডুবে যাচ্ছে। যে শাসকরা একসময় ‘ফিলিস্তিন মুক্ত হোক!’ বলে গর্জে উঠতেন, তারা আজ হাসিমুখে ইসরায়েলি প্রতিনিধিদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন।
আর ট্রাম্প তাদের পুরস্কার দেন অস্ত্র, আশ্রয় ও এক রকম রাজনৈতিক দায়মুক্তি, যা আরব রক্তে কেনা।”
‘গণতন্ত্র’ আর ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ’ উপসাগরীয় শাসকদের কাছে এখন এক আতঙ্কের নাম। তাদের কাছে প্রকৃত হুমকি ইসরায়েল নয়, এমনকি ইরানও নয়। তাদের সবচেয়ে বড় ভয় তাদের নিজ জনগণ যারা স্বাধীনতা, ন্যায় ও মর্যাদার দাবি তোলে। এই ভয়ে তারা এখন শয়তানের সঙ্গে চুক্তি করে।
ট্রাম্পের দাবি পরিষ্কার, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করো, তার আধিপত্য মেনে নাও, আর ফিলিস্তিনের নাম পর্যন্ত নিও না। ট্রাম্প কেবল শক্তিকে সম্মান করেন। তিনি পুতিনের প্রশংসা করেন, এরদোয়ানকে ‘বুদ্ধিমান’ বলেন; কারণ তারা নিজেদের জাতির স্বার্থে দাঁড়ান। আরব শাসকরা তা পারেন না, তারা কেবল কুর্নিশ করে যান।
ট্রাম্প একবার প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘আমরা না থাকলে সালমান দুই সপ্তাহও টিকত না।’ আর এই অপমান সত্ত্বেও তারা তার পায়ে উপহার প্রদান করে। উপসাগরীয় বিলিয়ন ডলার কেবল ট্রাম্প প্রশাসন নয়, তার পারিবারিক ব্যবসাও সমৃদ্ধ করছে।
যখন রিয়াদে করতালি চলছিল, তখন ইসরায়েলি বিমান গাজার হাসপাতালগুলোতে বোমা ফেলছিল।
ইউরোপীয় হাসপাতাল কিংবা নাসের হাসপাতাল সব ধ্বংসের মুখে। সাংবাদিক থেকে চিকিৎসক, সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করছে দখলদার বাহিনী।
আর এরই মধ্যে ট্রাম্প ফটোশুট করছিলেন, উপহার নিচ্ছিলেন, আরো চুক্তি চাচ্ছিলেন। এটাই আরব শাসকদের নীরবতার রক্তাক্ত মূল্য।
এই সফর, এই আলোচনার নামে চলা বিনিময় কোনোভাবেই কূটনীতি নয়। এটি এক বিলাসী প্রহসন, যেখানে নেতৃত্ব নেই, বিবেক নেই, আছে শুধু স্বৈরতন্ত্রের স্বীকৃতি, দমন-পীড়নের বৈধতা। ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন কেবল একটি ব্যক্তির নয়, এটি এক দৃষ্টিভঙ্গির ফিরে আসা, যেখানে গণহত্যা পুরস্কার পায় এবং আনুগত্যই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার একমাত্র টিকিট।
উপসাগরীয় শাসকরা ইতিহাসে সম্মানজনক গন্তব্যে নিজেদের নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা নিজেদের ঠাঁই দিয়েছেন সেই জায়গায়, যেখানে বসে ইতিহাস লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নেয়।