Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

তুরস্ক-কুর্দি সম্পর্কের নতুন ভোর

Icon

মো. ইমরানুর রহমান

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫, ১৭:১২

তুরস্ক-কুর্দি সম্পর্কের নতুন ভোর

ছবি: সংগৃহীত

স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষায় তুরস্কের সঙ্গে চার দশকের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর নিজেদের বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে)। একই সঙ্গে দলটি সব ধরনের সশস্ত্র কর্মকাণ্ড বন্ধেরও ঘোষণা দিয়েছে। ১২ মে পিকেকে ও তুরস্ক সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। 

দুই পক্ষের ঘোষণার মধ্য দিয়ে তুরস্ক-কুর্দি দ্বন্দ্বের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। চার দশকের রক্ত ক্ষয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অসংখ্য প্রাণহানির পর অবশেষে বন্দুক নেমে এলো, সম্ভবত ইতিহাসের দাবি মেনে। পিকেকের এমন উদ্যোগে নিজের দেশের বিরোধীদের চাপা থাকা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আবারও শক্তিশালী অবস্থানে চলে যেতে পারবেন।

দেশে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ছাড়াও সিরিয়া ও ইরাকের মতো দেশেও তার প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। ফলে শুধু শান্তি প্রতিষ্ঠাই নয় এ কথা বলাই যায়, নিকট ভবিষ্যতে আমরা আরো শক্তিশালী তুরস্ক দেখতে পারছি। 

সংঘাতের অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার চেষ্টা : পিকেকে যে একদিন অস্ত্র ত্যাগ করবে, তা অনেকের কাছেই একসময় কল্পনার মতো ছিল। তবে বাস্তবতা বদলায়, সময় বদলায়, আর হয়তো নেতাদের উপলব্ধিও বদলায়। ১৯৮৪ সালে যাত্রা শুরু করা এই গেরিলা সংগঠন তুরস্কের কুর্দি জনগোষ্ঠীর অধিকারের প্রশ্নে যে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করেছিল, তার ফল ছিল ভয়াবহ।

সেনাঘাঁটি, নিরাপত্তা বাহিনী এমনকি বেসামরিক নাগরিক কেউই ছাড় পায়নি। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় তুর্কি রাষ্ট্রও চালিয়েছে কঠোর সামরিক অভিযান, যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও ছিল প্রবল।

এমনকি সীমান্ত পেরিয়ে ইরাক ও সিরিয়ায় বসবাসরত কুর্দিদের ওপর চড়াও হতো তুরস্ক। তবে সময়ের ধারায় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বাস্তবতা যে অনেক কিছু বদলে দেয়, তারই প্রমাণ এই ঘোষণাটি।

এখনই বা কেন? : বিশ্লেষকদের মতে, পিকেকের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। একসময় সিরিয়া ও ইরাকে কুর্দিদের আইএস-বিরোধী লড়াইয়ে পশ্চিমা সমর্থন থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই সমর্থন স্পষ্টভাবেই কমে আসছে।

যুক্তরাষ্ট্রও ‘সন্ত্রাসবাদে মদদ’ দেওয়ার অভিযোগে সংগঠনটির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছে। সিরিয়া থেকেও আর সহায়তা পাওয়ার কোনো সুযোগ পিকেকের নেই। কারণ দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল শারার তুরস্কের পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। 

এ ছাড়া কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের লড়াইয়ে ভেতরের ক্লান্তিও চেপে ধরেছে। প্রজন্মান্তরের যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছেÑনতুন কুর্দিরা আর যুদ্ধ চান না। তারাই এখন বলছেন, ‘আর কতকাল?’ নতুন প্রজন্ম রাজনীতি ও সংস্কৃতির মাধ্যমে পরিচিতি চায়, বন্দুক বা গোলাবারুদের জোরে নয়।

তুরস্কও তার আগ্রাসী মনোভাব ছেড়ে কিছুটা কৌশলী ও নরম অবস্থান স্পষ্ট করেছে। এরদোয়ান সম্প্রতি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিষয়ে কিছু ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন। রাজনীতি ও গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কুর্দিদের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেওয়ার কথাও উঠে এসেছে।

পিকেকের বিদায় মানেই শান্তি? : প্রশ্নটা সহজ হলেও জবাব জটিল। কারণ পিকেকের অস্ত্র ত্যাগ করা মানেই কি কুর্দি প্রশ্নের সমাধান? তুরস্কজুড়ে এখনো হাজারো কুর্দি তরুণ রয়েছে, যারা বঞ্চনার অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হয়েছে। তাদের মনে আশা জন্মাতে হবে যুদ্ধ নয়, শান্তির পথেই অধিকারের সন্ধান মিলবে।

তুরস্ক যদি সত্যি চায় স্থায়ী শান্তি, তবে শুধু পিকেকের অস্ত্র নামিয়ে রাখা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন কুর্দিদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, ভাষা-সংস্কৃতির স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা।

কী হতে পারে পরবর্তী ধাপ : শুরুতে সর্বজনীন সাধারণ ক্ষমা ও পুনর্বাসনের কার্যক্রম শুরু হতে পারে। যারা লড়াই ছেড়ে ফিরতে চায়, তাদের নিরাপত্তা ও সমাজে পুনস্থাপনের পথ খুলতে হবে। কুর্দি অধ্যুষিত এলাকাগুলোর প্রশাসনে স্থানীয়দের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে।

এ ছাড়া স্বাধীন গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক ভাবধারা প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর যেকোনো বিধিনিষেধ ধীরে ধীরে সরিয়ে নিতে হবে। স্থায়ী শান্তি চাইলে তুরস্ককে অবশ্যই একটি জাতীয় পর্যবেক্ষণ কমিশন গঠন করতে হবে। কারণ শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস পর্যালোচনার জন্য নিরপেক্ষ কমিশন গঠন প্রয়োজন।

ইতিহাস কি বদলাবে : চার দশকের যুদ্ধে বিজয়ী কেউ নয়, হেরেছে কেবল সাধারণ মানুষ। পিকেকের বিদায় ঘোষণা সেই হতাশার মাটি থেকে আশার অঙ্কুর। তুরস্ক যদি চায় সত্যিকার অর্থে আধুনিক, বহুজাতিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে, তবে এই মুহূর্ত তাদের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ।

শান্তি ঘোষণাকে যদি কেবল কৌশল হিসেবে দেখার ভুল করে তারা, তবে সামনে অপেক্ষা করছে নতুন সংকট। কিন্তু যদি এই সুযোগকে তারা ভবিষ্যতের ভিত্তি বানায়, তবে ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের শুরু হবে, যার নাম হবে সহাবস্থান। একপাক্ষিক লড়াই শেষ হয়েছে।

এখন দরকার দুই পক্ষের হাতে হাতে ধরা, আস্থা গড়ে তোলা। কারণ ইতিহাস থেকে এই জানা যায়, যুদ্ধ শেষ হলেও শান্তি নিজে থেকে আসে না, তাকে তৈরি করতে হয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫