Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

যুক্তরাষ্ট্র কেন শ্বেতাঙ্গদের স্বাগত জানাচ্ছে

Icon

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫, ১৯:৩৫

যুক্তরাষ্ট্র কেন শ্বেতাঙ্গদের স্বাগত জানাচ্ছে

মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টোফার ল্যান্ডো ১২ মে যুক্তরাষ্ট্রের ডালেস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আফ্রিকানার শরণার্থীদের স্বাগত জানান। ছবি: এপি

জানুয়ারিতে কেনিয়ায় পার্কের বাইরে একটি গাড়িতে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে রাত পার করছিলেন পাসিটো (ছদ্মনাম)। তার সকালটা শুরু হয় বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাস দিয়ে। পরিবারটি কঙ্গো প্রজাতন্ত্র (ডিআরসি) থেকে শরণার্থী হয়ে কেনিয়ায় এসেছিল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাদের যুক্তরাষ্ট্রগামী বিমানে ওঠার কথা ছিল।

পরিবারটির যেদিন কেনিয়া ছাড়ার কথা ছিল তার দুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের শরণার্থী প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিমান ছাড়ার ২৪ ঘণ্টারও কম সময় আগে প্যাটিকোকে জানানো হয়, তাদের যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার অনুমতি বাতিল হয়েছে।

বিবিসিকে তিনি বলেন, “আমার আর কোথাও যাওয়ার ছিল না।”

যুক্তরাষ্ট্রে নতুন জীবন শুরু করার আশায় তিনি বাড়ি, আসবাবপত্র ও নিজেদের মালিকানায় থাকা প্রায় সবকিছু বিক্রি করে দিয়েছিলেন। ডিআরসি থেকে পালিয়ে আসার পর কেনিয়ায় থাকাটা তাদের জন্য অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ছিল।

পাসিটো আর তার পরিবারের সদস্যরা প্রায় এক লাখ ২০ হাজার শরণার্থীর তিনজন ছিলেন, যারা শর্তসাপেক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার অনুমতি পেয়েছিলেন। তবে শরণার্থী প্রকল্প বাতিল হওয়ায় তারা এক অচলাবস্থার মধ্যে অপেক্ষা করছেন।

ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত আগের প্রেসিডেন্টদের নীতি থেকে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ২০২৪ সালে এক লাখের বেশি শরণার্থী যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকেন। এটি তিন দশকের মধ্যে ওই বছরই সবচেয়ে বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার ঘটনা ছিল।

জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পরই ট্রাম্প নির্বাচনি প্রচারের সময় তার বলা ‘সবার আগে আমেরিকা’ নীতির বাস্তবায়ন শুরু করেন। এর মধ্যে নাটকীয়ভাবে অভিবাসীদের আসার রাস্তাগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্তও ছিল।

এই প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর উচ্চাভিলাসী প্রকল্প। এর আওতায় বিচারকের রায় উপেক্ষা করে অভিবাসীদের এল সালভাদরের কুখ্যাত কারাগারে পাঠানোর ঘটনাও ঘটেছে। একই সঙ্গে হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর ভিসাও বাতিল করে ট্রাম্প প্রশাসন। নিজে নিজে ফেরত যাওয়ার জন্য অভিবাসীদের এক হাজার ডলার করে দেওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।

হোয়াইট অজুহাত দেখিয়েছে, যাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে এরা হয় সহিংস অপরাধী অথবা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি হুমকি।

তবে বাছাই করা কিছু মানুষের জন্য ব্যতিক্রমের ব্যবস্থাও রেখেছে ট্রাম্প প্রশাসন।

ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। সেখানে তিনি বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের জন্য শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে আসার সুযোগ রাখেন। ট্রাম্পের দাবি, ওই শ্বেতাঙ্গরা ‘বর্ণবাদী বৈষম্যের শিকার’।

চলতি বছরের শুরুতে এরকম ৫৯ জন শরণার্থীকে নিয়ে একটি বিমান ওয়াশিংটন ডিসির বাইরের বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ‘আফ্রিকানারস’ নামে পরিচিত এই অভিবাসীদের স্বাগত জানাতে হাজির হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের খোদ সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীও।

ষোল শতকে আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনকারী ডাচদের বংশধররা দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘আফ্রিকানারস’ নামে পরিচিত।

মাত্র তিন মাসে এই শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া নিয়ে ক্ষোভ জানান প্যাটিকো। অথচ সব প্রক্রিয়া অনুসরণের পরেও তাকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।

এই পরিস্থিতি পাসিটোকে অচলাবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। একজন সঙ্গীত শিল্পের কর্মী হিসেবে সব যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দিয়েছিলেন তিনি। এখন বেঁচে থাকার জন্য কষ্টকর কাজও খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে তাকে।

আফ্রিকানারসদের শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করার পেছনে ট্রাম্পের দাবি, তারা দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘গণহত্যার’ মুখে পড়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইলন মাস্কের মুখেও এমন দাবি শোনা গেছে।

এ ধরনের অভিযোগ কয়েক বছর ধরেই আসছে, যদিও এর বেশিরভাগই ভুয়া। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারও আফ্রিকানারসদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থিদের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি শত্রু ভাবাপন্নতাও তৈরি হয়েছে। জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকা একটি আইন পাস করে। সেখানে ‘ন্যায়সঙ্গতভাবে এবং জনস্বার্থে’ শ্বেতাঙ্গ মালিকদের কাছ থেকে জমি জব্দ করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

এই আইনটি করা হয়েছে জমির মালিকানায় বৈষম্য নিয়ে বর্ণবাদ-উত্তর যুগে দেশটির সমাজে তৈরি হওয়া অসন্তোষ দূর করতে। শ্বেতাঙ্গরা দক্ষিণ আফ্রিকার জনসংখ্যার সাত শতাংশ হলেও তারা ৭২ শতাংশ জমির মালিক।

যদিও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা জানিয়েছেন, নতুন আইনের আওতায় কোনো জমি জব্দ করা হয়নি। এই আইন পাস হওয়ার পরের দিন ট্রাম্প দেশটিতে কয়েকশ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা স্থগিতের আদেশ দেন। দুটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক বৈরিতাও শুরু হয়।

ট্রাম্প ইতোমধ্যে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে দক্ষিণ আফ্রিকায় এইডস মোকাবিলায় বরাদ্দ করা শতকোটি ডলারের সহায়তা বাতিল করেছেন।

ইতোমধ্যে শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে আনা নিয়ে শরণার্থী সংগঠনগুলো প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

গ্লোবাল রিফিউজি নামের একটি সংস্থার কর্মকর্তা টিমোথি ইয়ং বিবিসিকে বলেন, “সুরক্ষা দেওয়ার প্রত্যেকটি ঘটনা নির্যাতনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে হওয়া দরকার। প্রশ্নটা এখন সমতা ও আইনের দৃষ্টিতে সমানভাবে দেখার।’

“যদি একটি গোষ্ঠী মানবিক সহায়তার পথ পেতে পারে, তাহলে আফগান মিত্ররা, নিপীড়িত ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা এবং হাজারও পরিবার, যারা গুরুতর হুমকির মুখে আছে এবং যারা আইনিভাবে শরণার্থী হওয়ার মানদণ্ড পূরণ করে, তারাও সেই সুযোগ পাওয়ার যোগ্য,” বলেন ইয়ং।

ট্রাম্প প্রশাসন তাদের অন্য পদক্ষেপগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা আফগানদের জন্য অস্থায়ী সুরক্ষা মর্যাদা নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রশাসনের দাবি, ‘আফগানিস্তানে নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে’ এবং ‘অর্থনীতি স্থিতিশীল হচ্ছে’। এখন এসব আফগানকে দেশে ফেরত পাঠানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকা জাতিগত ভিত্তিতে অপরাধের সংখ্যা প্রকাশ করে না। তবে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে দেশটিতে ৬ হাজার ৯৫৩ জন মানুষ খুন হয়েছে।

এই সময়ে ১২ জন খুন হয়েছেন খামারে আক্রমণের ঘটনায়। এদের মধ্যে একজন ছিলেন খামার মালিক, যিনি সাধারণ শ্বেতাঙ্গ। পাঁচজন ছিলেন খামারের বাসিন্দা এবং চারজন কর্মচারী, যাদের কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

অন্যদিকে, কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে (ডিআরসি) সশস্ত্র মিলিশিয়াদের হাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন এবং জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী প্রায় এক লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন।

পাসিটো ২০১৬ সালে পায়ে হেঁটে ডিআরসি থেকে পালিয়ে আসেন। তিনি জানান, সেই সময় চারপাশে ছিল শুধু বন্দুক আর কোনো শান্তি ছিল না। তার স্ত্রীর পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করা হয়েছিল।

যারা এখন যুক্তরাষ্ট্রকে আর শরণার্থী হিসেবে পুনর্বাসনের সম্ভাব্য স্থান হিসেবে ভাবছে না, তাদের মধ্যে হাম্মাদ পরিবারও আছে। তারা গাজার বাসিন্দা, বর্তমানে মিসরে থাকছেন।

“ট্রাম্প যা করলেন, তার পর মনে হচ্ছে এখন আর যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া অসম্ভব,” বিবিসিকে বলেন আমজাদ হাম্মাদ।

তিনি ও তার পরিবার ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ড লটারি প্রোগ্রামের জন্য আবেদন করেছিলেন। তারা মে মাসে জানতে পারেন যে তাদের আবেদন বাতিল হয়েছে।

তিনি ট্রাম্পের, দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের প্রতি উদ্বেগ, কিন্তু অন্যদের প্রতি উপেক্ষা নিয়ে নিজের বিভ্রান্তি জানান।

“দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ যদি গণহত্যার মুখে থাকে, তাহলে ফিলিস্তিনিরা কী অবস্থায় আছে?”-প্রশ্ন তোলেন তিনি।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি অভিযানে ৫৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ওইদিন হামাস ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে সীমান্ত পার হয়ে হামলা চালিয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষকে হত্যা ও ২৫১ জনকে জিম্মি করে। এর জবাবে ইসরায়েল গাজায় অভিযান শুরু করে।

হাম্মাদের এই বিভ্রান্তি পাসিটোর অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে, যার যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসনের আশা জানুয়ারিতে ভেঙে যায়।

এরপর থেকে তিনি কার্যত নাইরোবিতে গৃহহীন অবস্থায় আছেন। কয়েক দিনের জন্য কেউ আশ্রয় দিলে সেখানেই থাকেন।

“কখনো খাবার জোটে, কখনো জোটে না,”-বলেন তিনি। “আমরা খুবই কষ্টে আছি।”

যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত পরিবর্তন তার মনে কোনো আশা জাগায় না যে ট্রাম্প তাকে গ্রহণ করবেন। তবে আফ্রিকা পেরিয়ে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার বিকল্পটিও তার কাছে অকল্পনীয়। তিনি বলেন, “আমি সেখানে ফিরতে পারি না।”


 



Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫