ইউরোপকে কি কোণঠাসা করবে ট্রাম্পের শুল্ক নীতি?

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫, ১৯:২৫

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৩ মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বিরুদ্ধে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। এর পর থেকে বাণিজ্য সচেতন সবার মনে একটাই প্রশ্ন জেগেছে, ইউরোপকে কি কোণঠাসা করবে ট্রাম্পের শুল্ক নীতি? ইইউয়ের বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়ে ট্রাম্প জানিয়েছেন, ইইউয়ের বাণিজ্য নীতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এই পরিস্থিতি পরিবর্তন না হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি আরো বাড়তে পারে। ট্রাম্প তার টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘ইইউ আমাদের সঙ্গে বাণিজ্য করতে গিয়ে নানা ধরনের বাধা সৃষ্টি করছে, যার ফলে প্রতি বছর ২৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বাণিজ্য ঘাটতি হচ্ছে। এটা একেবারে অগ্রহণযোগ্য।’ ট্রাম্পের এই মন্তব্যের পরই শুধু ইউরোপ নয়, বিশ্বের বাণিজ্য বাজারে নতুন করে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। ট্রাম্পের এই টুইটকে এক ধরনের সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা, যেখানে ট্রাম্প ইইউয়ের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেছেন।
ট্রাম্প বলেছেন, ইইউ তাদের ভ্যাট-ট্যাক্স, ডিজিটাল সার্ভিস ট্যাক্স (ডিএসটি) এবং অন্যান্য অমৌলিক বাণিজ্য বাধার মাধ্যমে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অস্বাভাবিক চাপ তৈরি করছে। বিশেষ করে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমনÑঅ্যামাজন, গুগল, ফেসবুক ও অ্যাপলÑএই শুল্কের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের পর ইইউয়ের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লায়েন বলেছেন, ‘আমরা সম্মানজনক আলোচনা চাই এবং হুমকির মাধ্যমে বাণিজ্য সমাধান করতে চাই না।’ তিনি আরো জানিয়েছেন, ইইউ বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নতির জন্য সব সময় প্রস্তুত রয়েছে, তবে তারা ট্রাম্পের এই হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তেও প্রস্তুত।
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য সম্পর্ককে আরো জটিল করে তুলতে পারে। ২০১৮ সালে যখন ট্রাম্প প্রথম বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তখনো চীন ও ইউরোপের বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপ করেছিলেন। এরপর কিছুটা সময় গড়িয়ে গেলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে নতুন এই শুল্ক হুমকি একটি নতুন বাণিজ্যযুদ্ধের ইঙ্গিত দেয়। বিশ্বের শেয়ার বাজারেও এই হুমকির প্রভাব পড়েছে। ২৩ মে ইউরোপীয় বাজারে বড় ধরনের পতন দেখা গেছে। জার্মানির ড্যাক্স, ফ্রান্সের সিএসসি এবং লন্ডনের এফটিএসই ইনডেক্স প্রায় ২ শতাংশ করে পড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারও নেতিবাচকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, নিউইয়র্কের ডাও জোন্স ইনডেক্স প্রায় ৫০০ পয়েন্ট পতন করেছে। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের ফলে চীন-ভারতসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্য আলোচনাও আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
যদিও ট্রাম্প দাবি করছেন তার দেশ অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে ভারত ও এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে ভালো বাণিজ্য চুক্তি করতে সক্ষম হচ্ছে। একই সময়ে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের হুমকির কারণে বিশ্বের বাণিজ্য বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, যদি ইইউ এই শুল্কের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেয়, তবে তা শুধু ইউরোপের অর্থনীতি নয়, সমগ্র বিশ্ব অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ফলে ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ শুধু মার্কিন-ইইউ সম্পর্ককেই প্রভাবিত করবে না, বরং সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্পর্ককেও জটিল করবে। এ ছাড়া ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের হুমকির পর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউয়ের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিশ্লেষণ উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই শুল্ক-পরবর্তী পদক্ষেপ বিশ্ববাজারে মুদ্রা বিনিময় হার এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের খরচকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এতে করে কাঁচামাল, শিল্পপণ্য ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন করে মূল্যবৃদ্ধি দেখা যেতে পারে, যা সাধারণ ভোক্তার জন্য আরো চাপ সৃষ্টি করবে। সুতরাং যদি ইইউ বা অন্যান্য দেশ ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেন, তবে তা বাণিজ্যযুদ্ধের তীব্রতা আরো বাড়িয়ে তুলবে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতি এবং চুক্তি ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিতে পারে, বিশেষ করে যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউয়ের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল।
সম্প্রতি বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে ধীরগতির প্রভাব এবং বাণিজ্যিক বাধার কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো যেমন ভারত ও ব্রাজিল, তাদের জাতীয় শিল্প ও কৃষি খাতের ওপর নির্দিষ্ট চাপ অনুভব করছে। সেই সঙ্গে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে একের পর এক সতর্কতা আসছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউয়ের মধ্যকার বাণিজ্যের অস্থিরতা বিশ্ব অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যা ইউরোপ তো বটেই, বিশ্বজুড়ে বড় ধরনের মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করতে পারে।