ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রে তালেবান
স্বীকৃতি না পেলেও সংযুক্তি জোরদার

স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ১৪:২৯

চীনের চিন গাং ও পাকিস্তানের বিলওয়াল ভুট্টোর সঙ্গে তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পেলেও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে তালেবান সরকারের অবস্থান দিন দিন দৃঢ় হচ্ছে। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির কূটনৈতিক কর্মসূচি ছিল ব্যস্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ। ১৫ মে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তাকে ফোন করে কাশ্মীরের পেহেলগাম হামলার নিন্দা জানানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। ১৭ মে মুত্তাকি তেহরানে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি ও প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে বৈঠক করেন। ২১ মে তিনি বেইজিংয়ে চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেন, যেখানে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান পারস্পরিক রাষ্ট্রদূত নিয়োগে সম্মত হয় এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর আগে মাসের প্রথম সপ্তাহে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গাং ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টোর সঙ্গে ইসলামাবাদে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন মুত্তাকি। বিশ্লেষকদের মতে, এখন এসব দেশ তালেবানকে আর বিচ্ছিন্ন বা বর্জিত শাসক হিসেবে দেখছে না, যদিও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এখনো অনুপস্থিত।
২০২৪ সালে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর মাত্র ছয়টি দেশÑচীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক ও ইরানÑকাবুলে দূতাবাস চালু রেখেছিল। তবে ঐতিহাসিক ও কৌশলগত বাস্তবতায় এখন আরো অনেক দেশ তালেবান সরকারের সঙ্গে সংযোগ বাড়াচ্ছে। তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও উজবেকিস্তান তালেবানের সঙ্গে বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন খাতে সহযোগিতা সম্প্রসারণ করেছে। এই সংযুক্তির মূল চালিকা শক্তিÑসন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, আঞ্চলিক বাণিজ্যপথ পুনরুজ্জীবন এবং শরণার্থী সংকট ব্যবস্থাপনা। তালেবানের প্রথম শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) ভারত কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নর্দান অ্যালায়েন্সকে সমর্থন দিয়েছিল। তালেবানকে তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানের ‘প্রক্সি’হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু ২০০১ সালের পর ভারত আফগানিস্তানে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে দৃশ্যমান উন্নয়ন সহযোগী হয়ে ওঠে।
২০২১ সালে তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় এলে ভারত দূতাবাস বন্ধ করলেও ২০২২ সালে ‘প্রযুক্তিগত দল’ পাঠিয়ে সীমিত কূটনৈতিক উপস্থিতি পুনঃস্থাপন করে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দুবাইয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি ও তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাকির মধ্যে সরাসরি বৈঠক হয়, যা দুই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ হিসেবে ধরা হচ্ছে। বিশ্লেষক কবির তানেজার মতে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে ভারতের পক্ষে আফগানিস্তানকে উপেক্ষা করার আর সুযোগ নেই। চ্যাথাম হাউসের গবেষণাও বলছে, ভারতের এই উচ্চপর্যায়ের সংযোগ তালেবান প্রশাসনকে আঞ্চলিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা এনে দিয়েছে, যেখানে চালিকাশক্তি নৈতিকতা নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা।
চীনের চিন গাং ও পাকিস্তানের বিলাওয়াল ভুট্টোর সঙ্গে তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি অন্যদিকে ১৯৯৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান তালেবানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল। কিন্তু ২০২১ সালের পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে টিটিপির (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) সন্ত্রাসী তৎপরতা ইসলামাবাদকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। পাকিস্তান দাবি করছে, টিটিপির ঘাঁটি আফগানিস্তানে; তালেবান যদিও তা অস্বীকার করে। সীমান্ত পরিস্থিতি ও শরণার্থী সমস্যাও এই সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এক দিনের কাবুল সফরে গিয়ে সন্ত্রাসবাদ ও বাণিজ্য বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেন।
পাকিস্তান পারস্পরিক নিরাপত্তা সহযোগিতা ও বাণিজ্য সংযোগে আগ্রহ প্রকাশ করে। বিশ্লেষক রাবিয়া আখতারের মতে, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং ভারতের সঙ্গে তালেবান সরকারের ঘনিষ্ঠতা বাড়ার আশঙ্কাই পাকিস্তানকে এই সম্পর্ক পুনর্গঠনে আগ্রহী করছে। ইরান তালেবানের প্রথম শাসনে ছিল দৃঢ় বিরোধী। ১৯৯৮ সালে ইরানি কূটনীতিকদের হত্যা দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করেছিল। তবে ২০০১ সালের পর মার্কিন আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে ইরান তালেবানের সঙ্গে সীমিত যোগাযোগ শুরু করে। ২০২৫ সালে তেহরানে তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে সীমান্ত নিরাপত্তা, জঙ্গি দমন ও হেলমন্দ নদীর পানি বণ্টনসহ নানা ইস্যু আলোচিত হয়।
ইরানে অবস্থানরত প্রায় ৬০ লাখ আফগান শরণার্থী ও জলবণ্টন বিতর্ক এই সংলাপে কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। যদিও ইরান তালেবানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, তবু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে তারা আগ্রহী। রাশিয়াও তালেবানের প্রথম শাসনে উত্তরাঞ্চলীয় জোটকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু বর্তমানে রাশিয়ার প্রধান উদ্বেগ, আফগানিস্তান যেন সন্ত্রাসের উৎস না হয়ে ওঠে। কাজেই বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং সীমিত সংযুক্তিকেই কৌশলগত পন্থা হিসেবে গ্রহণ করছে রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো। কাজাখস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি কাবুল সফরে গিয়েছেন বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে। এই পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিকল্প বলে দেখা যেতে পারে; আবার একে আঞ্চলিক কৌশলগত পুনর্গঠনেরই অংশও বলা যায়। তালেবানশাসিত আফগানিস্তান এখন এক অনস্বীকার্য ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা।
২০২৪
সালের শেষ নাগাদ তালেবান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি, তারা ১১টি দেশে কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব
স্থাপন করেছে, যদিও চীনই এখন পর্যন্ত একমাত্র দেশ যারা আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রদূত বিনিময়
করেছে। তালেবানের দোহা কার্যালয়ের মুখপাত্র সুফাইল শাহীন বলেন, আঞ্চলিক দেশগুলো এখন
বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিচ্ছে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তালেবান
এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য ‘প্রতীক্ষা নয়, প্রস্তুতি’তে আছে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা
নিশ্চিত করতে যৌথ কার্যক্রমে আগ্রহী। পশ্চিমা বিশ্ব এখনো তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি
দিতে অনাগ্রহীÑনারী অধিকার, অন্তর্ভুক্তিমূলক
শাসন ও মানবাধিকারের প্রশ্নে উদ্বেগ থাকায়। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনো অনিশ্চিত হলেও
আঞ্চলিক রাজনীতির বাস্তবতায় তালেবান প্রশাসনের অন্তর্ভুক্তি এখন প্রায় অনিবার্য। ভবিষ্যতে
এই সংযুক্তিই কি স্বীকৃতির ভিত্তি হয়ে উঠবে, না কি নতুন