আইসিসির ৪ বিচারকের ওপর নিষেধাজ্ঞা ট্রাম্প প্রশাসনের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২৫, ১৯:৪২

ট্রাম্পের পদক্ষেপ আইসিসির ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) চারজন বিচারকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে ‘অবৈধ ও ভিত্তিহীন পদক্ষেপ’ নেওয়ার অভিযোগে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার এক লিখিত বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এই নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেন।
রুবিও লেখেন, “আইসিসি একটি রাজনীতিকীকৃত প্রতিষ্ঠান, যারা ভুলভাবে দাবি করছে যে তারা আমাদের ও আমাদের মিত্রদের নাগরিকদের তদন্ত, অভিযোগ ও বিচার করতে পারে। এই ভয়ানক দাবি ও ক্ষমতার অপব্যবহার যুক্তরাষ্ট্র ও আমাদের মিত্রদের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার ওপর আঘাত।”
যেসব বিচারকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তারা হলেন উগান্ডার সলোমি বালুংগি বসা, পেরুর লুজ দেল কারমেন ইবানেজ কারানজা, বেনিনের রেইন অ্যাডেলাইড সোফি আলাপিনি গাঁসো এবং স্লোভেনিয়ার বেটি হোহলার।
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের কোনো সম্পদ থাকলে তা জব্দ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো তাদের সঙ্গে লেনদেন করতে পারবে না, এমনকি অর্থ, পণ্য বা সেবা দেওয়াও নিষিদ্ধ।
আইসিসি দ্রুতই এক বিবৃতি দিয়ে জানায়, তারা তাদের বিচারকদের পাশে আছে এবং ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানায়।
বিবৃতিতে বলা হয়, “এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক বিচারিক সংস্থার স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলছে, যার ম্যান্ডেট ১২৫টি সদস্য রাষ্ট্র দিয়েছে। যারা জবাবদিহির জন্য কাজ করে তাদের ওপর আক্রমণ করে সাধারণ মানুষকে কোনো সাহায্য করা যায় না। বরং এটি অপরাধীদের সাহস জোগায়।”
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বসা ও ইবানেজ কারানজার বিরুদ্ধে ২০২০ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে তদন্ত অনুমোদনের কারণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
আগে আইসিসি আফগানিস্তানে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের তদন্তের অনুমোদন দেয়নি। কিন্তু পরের বছর তারা তদন্তের অনুমোদন দেয়, যাতে মার্কিন সেনা ও সিআইএর সদস্যদের ‘গোপন বন্দিশালায়’ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়।
আইসিসি জানায়, আফগানিস্তান রোম সংবিধির সদস্য যেটি আইসিসির ১২৫ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে পড়ে।
তবে ট্রাম্প প্রশাসন আইসিসির এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে এবং একে ‘আইনের ছদ্মবেশে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান’ বলে আখ্যা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র রোম সংবিধির সদস্য নয়, তাই তারা আইসিসির এখতিয়ার মানে না।
একই যুক্তি দেখিয়ে ইসরায়েলও ফিলিস্তিনে তাদের কর্মকাণ্ডে আইসিসির ক্ষমতা অস্বীকার করে, কারণ তারাও রোম সংবিধির সদস্য নয়।
বৃহস্পতিবার নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা অন্য দুই বিচারক আলাপিনি গাঁসো ও হোহলার। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তারা ইসরায়েলি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলায় অংশ নিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পুরোনো মিত্র এবং ১৯৪৮ সালে প্রথম দেশ হিসেবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। যুক্তরাষ্ট্র গাজায় চলমান যুদ্ধে ইসরায়েলকে দৃঢ় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৪ হাজার ৬০৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো গাজার এই অভিযানকে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছে এবং নিয়মিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলছে।
২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে এই অভিযোগের ভিত্তিতে আইসিসি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াওভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তাদের বিরুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে।
আলাপিনি গাঁসো ও হোহলার এই বিচার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এটি ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে অফিসে ফেরার পর আইসিসির কোনো কর্মকর্তার ওপর প্রথম নিষেধাজ্ঞা নয়।
দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতেই ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে হুমকি দেন, আইসিসির যেকোনো তদন্তে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। সমালোচকেরা বলেন, এই ধরনের হুমকি সাক্ষীদের চুপ করে যেতে বাধ্য করতে পারে এবং বিচার প্রক্রিয়া ‘বাঁকা পথে’ চালিত হতে পারে।
ট্রাম্প বলেন, নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে পরোয়ানার কারণে এই ধরনের পদক্ষেপ দরকার ছিল।
তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ‘সবল গণতন্ত্র’ যেখানে ‘যুদ্ধের আইন কঠোরভাবে মানা হয়’। আইসিসির তদন্তে তাদের সেনারা হয়রানি, নিপীড়ন ও গ্রেপ্তার হুমকির মুখে পড়ে।
নির্বাহী আদেশে বলা হয়, “এই খারাপ কাজ যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং আমাদের ও আমাদের মিত্রদের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতিকে হুমকির মুখে ফেলে।”
এই আদেশের অধীনে আইসিসি কৌঁসুলি করিম খানকেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তিনিই নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে পরোয়ানার আবেদন করেছিলেন। এরপর গাজা বিষয়ক তদন্ত ধীর হয়ে পড়ে এবং পরে খান যৌন নিপীড়নের অভিযোগে পদত্যাগ করেন।
ট্রাম্পের আইসিসি-বিরোধী অবস্থান নতুন নয়। ২০১৯ সালে প্রথম মেয়াদে তিনি ঘোষণা দেন, আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে তদন্তে যুক্ত আইসিসি কর্মকর্তাদের ভিসা বাতিল করা হবে।
২০২০ সালে তিনি কৌঁসুলি ফাতু বেনসুদা ও কর্মকর্তা ফাকিসো মোচোকোকোকেও নিষেধাজ্ঞা দেন। পরে বাইডেন প্রশাসন এসব নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে।
তবে সমালোচকেরা বলেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ আইসিসির ওপর দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ আদেশ বাস্তবায়নে সদস্য দেশগুলোর সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে। আইসিসি এই হুমকি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।