রাষ্ট্রীয় সেবায় ক্ষুদ্রঋণকে যুক্ত করতে চান ইউনূস

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৫, ১৫:১৪

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
সামাজিক ব্যবসা ও ক্ষুদ্রঋণের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের কাজের ধরণ ও জনগণকে সেবা দেওয়ার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে চান প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছেন তিনি।
চার দিনের যুক্তরাজ্য সফরে থাকার সময় সেই সাক্ষাৎকারটি দেন প্রধান উপদেষ্টা, যেটি গত বৃহস্পতিবার পত্রিকাটির অনলাইন ভার্সনে প্রতিবেদন আকারে আসে।
সেই সাক্ষাৎকারে ইউনূসের রাষ্ট্র পরিচালনা, তার নানা পরিকল্পনার পাশাপাশি উঠে আসা ক্ষুদ্র ঋণ প্রসঙ্গও।
গার্ডিয়ান লিখেছে, ইউনূস চাইছেন, সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার মতো খাতে কাজ করা এবং তার প্রবর্তিত ক্ষুদ্রঋণ মডেলকে আরও বিস্তৃত করা।
‘কোনো ভুল নেই ক্ষুদ্রঋণে’
পত্রিকাটিকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কিছু নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়েছে বলে মনে করেন তিনি- বিশেষ করে উচ্চ সুদের কারণে।
ইউনূস বলেন, “মানুষ ভাবে, এটা যেন দরিদ্রদের কাছ থেকে টাকা কেটে নেওয়ার পদ্ধতি। কিন্তু আসলে তা নয়। ফলে এটাকে খারাপ নাম দেওয়া হয়েছে, তারপর বলা হচ্ছে- এটা ঠিক করতে হবে। কিন্তু ঠিক করার কিছু নেই … ক্ষুদ্রঋণে কোনো ভুল নেই।”
বর্তমানে এই খাতটি মূলত এনজিও-নির্ভর, যারা দরিদ্রদের ছোট ঋণ দিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করতে সহায়তা করে।
ইউনূস চান, এই ব্যবস্থাকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি স্বতন্ত্র ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যে আনা হোক। তিনি বলেন, “এতে উদ্যোক্তা হওয়ার পথ সহজ হবে, কারণ সাধারণ ব্যাংকগুলো দরিদ্র মানুষকে ঋণ দিতে চায় না।”
মূলধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থারও কঠোর সমালোচনা করেছেন ইউনূস। কারণ দরিদ্র মানুষ যাদের সম্পদ নেই, তারা ব্যাংকিং সেবা পান না। আবার গত এক বছরে অনেক ধনী-ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর বিশাল ঋণ ফেরত না দেওয়ার কারণে পুরো ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে, এমনকি মানুষ তাদের নিজের টাকা তুলতেও পারছিল না।
সরকারকে ‘শত্রু’ হিসেবে দেখে জনগণ
সরকারে আসার পর কয়েক মাসের মধ্যে যে ইউনূসের সমালোচনা হচ্ছে, সেটি টের পেয়েছেন তিনি।
গার্ডিয়ানকে তিনি বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাসনে পাঠানোর রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর হতে চললেও দেশের মানুষ এখনো সরকারকে ‘শত্রু’ হিসেবেই দেখে।
তার মতে, মানুষ সরকারের দিকে তাকায় শত্রু হিসেবে এবং জীবন কাটাতে হয় সেই শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করে। এই শত্রু অনেক শক্তিশালী, তাই মানুষ দূরে থাকতে চায়।
কিন্ত এমনটা চলতে থাকুক, তা আর ইউনূস চাইছেন না। তিনি বলেন, “আগে আমাকে আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতারা সমালোচনা করত। এখন সবাই সমালোচনা করে- এটা এখন উন্মুক্ত খেলা। এই জায়গায় থাকলে সেটা মেনে নিতে হবে। এটা জীবনেরই অংশ।”
দুর্নীতি উপড়ে ফেলাই উপায়
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “গ্রাম থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত প্রতিটি স্তর থেকে দুর্নীতি উপড়ে ফেলাই একমাত্র উপায়, যাতে মানুষ ‘নতুন বাংলাদেশে’ বিশ্বাস করতে পারে।”
বাংলাদেশ দুর্নীতিতে ডুবে ছিল বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সরকারি সদস্যদের অর্থ আত্মসাৎ এবং ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ না হওয়া—হোক তা পাসপোর্ট তৈরি কিংবা ব্যবসার অনুমোদনের আবেদন। অনেকে (সরকারি কর্মকর্তা) অপেক্ষাতেই থাকেন- কখন বিপুল সম্পদ আত্মসাৎ করতে পারবেন।
ইউনূস আরও বলেন, তিনি চান রাষ্ট্র এমন কিছু দিক থেকে জনগণের পাশে দাঁড়াক, যেখানে মানুষ এখন পর্যন্ত সরকারের উপস্থিতি অনুভব করতে পারেনি।
ব্রিটিশ পত্রিকাটি বলছে, আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনুগতদের জন্য বরাদ্দকৃত কোটা নিয়ে ছাত্রদের ক্ষোভ থেকে। তবে এর গভীরে ছিল জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং তরুণদের জন্য সম্ভাবনার অভাব।
শেখ হাসিনার শাসনামল ধীরে ধীরে স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল, যেখানে বিরোধীদের দমন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছিল। একই সঙ্গে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভেঙে পড়ার পেছনে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দুর্নীতিকে দায়ী করা হয়।
বহু মানুষ আশা করেছিল, ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে হওয়া এই আন্দোলন বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ—আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নিয়ন্ত্রিত বিষাক্ত ও সংঘাতপূর্ণ রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আনবে।
“আমাদের শুরুর অবস্থাটা ছিল এক ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি ও সমাজ থেকে। প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছিল,” বলেন ইউনূস।
“আমরা জানতাম না- আমাদের বিল দেওয়ার মতো টাকাও আছে কিনা। রাষ্ট্রীয় সম্পদ যেভাবে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছিল, তাতে মনে হচ্ছিল এ অর্থ যেন কারও নয়। ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছিল, জেনেও যে তা ফেরত আসবে না—এ যেন উপহার দেওয়া হচ্ছিল।” অন্তর্বর্তী সরকার জানুয়ারিতে কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে, যারা নির্বাচন, দুর্নীতি এবং কল্যাণনীতি নিয়ে সুপারিশ পেশ করেছে বলেও মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টা।
জুলাই সনদ হবে ঐতিহাসিক দলিল
ইউনূস এখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গঠনের ওপর জোর দিচ্ছেন এবং চান, ‘জুলাই সনদ’ আগামী মাসে আন্দোলনের প্রথম বর্ষপূর্তির আগেই চূড়ান্ত হোক, যেন এপ্রিলের নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন শুরু করা যায়।
দ্য গার্ডিয়ানকে তিনি বলেন, “এটা হবে একটি ঐতিহাসিক দলিল- যা সব পক্ষকে একত্র করবে। কমিশনগুলোর সুপারিশ হালকা কোনো পরামর্শ নয়। এগুলো মৌলিক সংস্কারের কথা বলে, একটু-আধটু কিছু করার বিষয় নয়।
“তারপর আমাদের কাজ হবে এসব বাস্তবায়ন করা এবং দেশকে প্রস্তুত করা—একটি সুস্থ, সচল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। এরপর আমরা বলতে পারব, আমরা ‘নতুন বাংলাদেশ’- এর শুরুতে দাঁড়িয়ে।”
‘বিএনপিই এগিয়ে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বী’
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপি, এখন দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী দল এবং আসন্ন নির্বাচনে এগিয়ে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বী। তারা নির্বাচন এগিয়ে আনার দাবি জানিয়ে আসছে এবং প্রধানমন্ত্রীর জন্য দুই মেয়াদের সীমাবদ্ধতার বিরোধিতা করেছে।
তবুও ইউনূস বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেভাবে এখন পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তা তাকে আশাবাদী করেছে। যেখানে অতীতে বিরোধী রাজনীতিকদের মধ্যে ঐকমত্যের কোনো উদাহরণ ছিল না।
তবে তিনি স্বীকার করেন, সব পক্ষের সম্মতি আদায় সহজ হবে না।
নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এপ্রিলের নির্বাচনের পর একটি নির্বাচিত সরকার আসবে, আর আমরা সরে যাব।”
এই সাক্ষাৎকারের পরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে রোজার আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট আয়োজনে একমত হয়েছেন বলে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে।