Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

তাড়া খেয়ে সে পথেই পালাচ্ছে ইসরায়েলিরা!

Icon

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫, ১১:২৭

তাড়া খেয়ে সে পথেই পালাচ্ছে ইসরায়েলিরা!

সাইপ্রাস থেকে ১৯৪৮ সালে জাহাজে করে এসেছিল ইসরায়েলিরা (বাঁয়ে), সাইপ্রাসের উদ্দেশে ইয়ট ধরে পালাতে সারিবদ্ধ ইসরায়েলিরা (ডানে)।

ইরান ও ইসরায়েল সংঘাতের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে ইসরায়েলিদের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যে সাইপ্রাস একসময় ইহুদি শরণার্থীদের জন্য ফিলিস্তিনে (বর্তমান ইসরায়েল) প্রবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট ছিল, আজ সেই পথেই বহু ইসরায়েলি দখল করা ফিলিস্তিন ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং হলোকাস্টের পর, হাজার হাজার ইহুদি শরণার্থী ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে অভিবাসনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা ফিলিস্তিনে প্রবেশের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকায়, অনেক ইহুদি অবৈধ পথে ফিলিস্তিনে ঢোকার চেষ্টা করেন।

সেই সময় সাইপ্রাস হয়ে উঠেছিল এই শরণার্থীদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে প্রায় ৫৩ হাজারেরও বেশি ইহুদি শরণার্থীকে সাইপ্রাসের ব্রিটিশ আটক কেন্দ্রগুলোতে রাখা হয়েছিল।

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর (১৯৪৮ সালে) সেখান থেকে বিপুল সংখ্যক ইহুদি ইসরায়েলে স্থানান্তরিত হন।

সাইপ্রাস ছিল তাদের জন্য একটি অস্থায়ী আশ্রয়স্থল, যেখান থেকে তারা অবশেষে তাদের ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’তে প্রবেশ করেছিলেন। যা আদ্যপে ফিলিস্তিনিদের দেশ।  

বর্তমানে, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের অবৈধ এই রাষ্ট্রের বাসিন্দাদের সেই চক্রাকার পথ ফিরে এসেছে।

ইসরায়েলি সরকার কর্তৃক বিমান সংস্থাগুলোকে নাগরিকদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর শত শত ইসরায়েলি নাগরিক, বিশেষ করে যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, তারা নীরবে ইয়ট বা প্রমোদতরীযোগে সাইপ্রাসের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ছেন।

ইসরায়েলি উপকূলের হার্জলিয়া, হাইফা এবং আশকেলনের মতো মারিনাগুলো থেকে এই ইয়টগুলো গোপন পথে যাত্রা করছে। জাহাজের অবস্থান জানান দেওয়ার সাইট ভ্যাসেল ফাইন্ডারেও এমন চিত্র ফুটে উঠেছে।

ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজ জানিয়েছে, তেল আবিব অভ্যন্তরীণ বিমান সংস্থাগুলোকে বহির্গামী ফ্লাইট বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার পরেই অনলাইনে বিভিন্ন গোষ্ঠী সমুদ্রপথে বিকল্প পালানোর পথ সমন্বয় করতে শুরু করে।

এই নির্দেশনায় জনগণের মধ্যে আরও উদ্বেগ বাড়ায় এবং সমুদ্রপথ সহ বিকল্প প্রস্থানের পথে ভিড় বাড়িয়ে তোলে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। বলছেন, ইচ্ছা করে তেলআবিব সরকার তাদেরকে ঝুঁকিতে ফেলছে। 

রির্জাভ সেনায় নাম লেখা এড়ানোর জন্যও পালাতে চাইছেন অনেকে। 

যারা দেশ ছাড়ছেন তাদের অধিকাংশই নিজেদের পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক, তবে তারা বিকল্পের অভাবের কথা উল্লেখ করছেন। ইয়ট পরিচালনাকারীরা বলছেন, যারা এই বিলাসবহুল ভ্রমণের খরচ বহন করতে সক্ষম, তাদেরও সমুদ্রপথে ‘কঠিন পরিস্থিতির’ সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

হার্জলিয়ার মারিনার ইয়ট বন্দর এখন অস্থায়ী ইসরায়েল ত্যাগের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।

সকাল থেকে ব্যক্তি, দম্পতি ও পরিবারগুলোকে সুটকেস হাতে এসে সাইপ্রাসের উদ্দেশ্যে ইয়টে চড়তে দেখা যাচ্ছে।

সেখান থেকে অনেকেরই পর্তুগাল ও ইতালির মতো দূরবর্তী গন্তব্যে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

সমুদ্রপথে যাত্রা সম্পর্কিত ফেসবুক গ্রুপগুলোর সদস্য সংখ্যা বেড়েছে, যেখানে শত শত মানুষ দেশ ছাড়ার উপায় খুঁজছেন বলে জানা গেছে।

চাহিদা বাড়ায় কিছু ইয়ট মালিক ২ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার শেকেল (প্রায় ৭১০ ডলার থেকে ১ হাজার ৭১০ ডলার) পর্যন্ত ফি নিয়ে স্থান অফার করছেন। বেশিরভাগ জাহাজে প্রতি যাত্রায় দশজনের বেশি যাত্রী নেওয়া হয় না।

এই প্রবণতা হার্জলিয়ার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। হাইফা এবং আশকেলনেও ছোট ইয়টের মালিকরা সমুদ্রপথে যাত্রা শুরু করেছেন।

ইসরায়েলের জনসংখ্যা ও অভিবাসন কর্তৃপক্ষ এই দেশত্যাগের সঠিক মাত্রা নির্ণয় করতে অক্ষম বলে জানিয়েছে। তবে অনেকেই বলছেন, দিন দিন ইসরায়েল ত্যাগে ইচ্ছুক মানুষের সংখ্যা নাটকীয় ভাবে বাড়ছে। 

পালাতে ইচ্ছুক অনেক যাত্রীই নিজেদের বিদেশি নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিলেও- তাদের অনেকেই আসলে ইসরায়েলি নাগরিক বলে জানিয়েছে হারেৎজ।

দ্য নিউ আরবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেউ কেউ সরাসরি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার হুমকি বাড়তে থাকায় পালানোর কথা স্বীকার করছেন। যদিও বেশিরভাগই প্রকাশ্যে কথা বলতে অস্বীকার করেছেন।

যাত্রার জন্য অপেক্ষারতদের মধ্যে একটি দম্পতি তাদের সন্তানের সঙ্গে নিয়ে হারেৎজের কাছে নীরবে স্বীকার করেছেন যে তারা যুদ্ধ থেকে পালাচ্ছেন। দম্পতি বলেন, “আমরা ক্ষেপণাস্ত্র দেখতে দেখতে ক্লান্ত।”

ইসরায়েলে দ্বৈত নাগরিকত্ব বেশ সাধারণ, বিশেষ করে ইহুদি অভিবাসী এবং তাদের বংশধরদের মধ্যে। প্রত্যাবর্তন আইন অনুযায়ী- বিশ্বব্যাপী ইহুদিদের তাদের মূল জাতীয়তা ত্যাগ না করেই ইসরায়েলে অভিবাসন এবং ইসরায়েলি নাগরিকত্ব অর্জনের অধিকার দেয়। যার ফলে ব্যাপক দ্বৈত নাগরিকত্বধারী লোক সেখানে আছে।

যারা এখন ইয়টে করে দেশ ছাড়ছেন তাদের অনেকেই দ্বৈত নাগরিক, যারা তাদের স্বদেশের পাসপোর্ট ধরে রেখেছেন অথবা ইসরায়েলে জন্মগ্রহণকারী নাগরিক যারা প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় দ্বিতীয় নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন।

ইসরায়েলিদের মধ্যে দ্বৈত নাগরিকত্বের সাথে প্রায়শই যুক্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ রাষ্ট্রসমূহ, রাশিয়া ও ইউক্রেন।

ছদ্মনামে আডি নামের একজন ব্যক্তি হারেৎজকে বলেন যে তিনি স্থায়ীভাবে চলে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, “আমি পর্তুগালে চলে যাচ্ছি” এবং ব্যাখ্যা করেন যে তার সঙ্গী কয়েক বছর ধরে সেখানে বাস করছেন এবং তাকে এখন যোগ দিতে অনুরোধ করেছেন।

মারিনায় দুজন পুরুষকে একটি ইয়টে জিনিসপত্র লোড করতে দেখা গেছে, কিন্তু তারা বিস্তারিত তথ্য দিতে অস্বীকার করেছেন।

হাইম ও তার ছেলে আমির সহ অন্যরা বলেছেন যে তাদের অন্য কোনো বিকল্প নেই। হাইম বলেন, “আমার ছেলে একজন ব্যবসায়ী। সে কয়েকদিন ধরে এখানে আটকা পড়ে আছে। সে লার্নাকায় সমুদ্রপথে যাবে এবং সেখান থেকে মিলানে উড়ে যাবে। সে পালাচ্ছে না- এটাই একমাত্র বিকল্প।”

অন্য একটি ইয়টের কাছে, যা ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, একজন বাবা-মা তাদের প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের সাথে অপেক্ষা করছিলেন, যে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ফিরে এসেছিল।

তিনি বলেন, “একবার যখন আমি বুঝলাম যে ফ্লাইটগুলো সহসা ফিরে আসছে না, তখন আমি পরিবহন মন্ত্রণালয়ে ফোন করলাম। তারা জর্ডান বা শারম এল-শেখ হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু আমি তা করতে চাইনি।”

তবে সবাই সমুদ্রের কঠোর পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত নন।

একজন ইয়ট ক্যাপ্টেন মোশে বলেন, “ঢেউ, বমি বমি ভাব- তারা কীসের মধ্যে পড়ছে সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।”

যারা নৌযাত্রায় সম্মত হন, তাদেরও কঠোর নিরাপত্তা ব্রিফিং দেওয়া হয়। একটি ক্রু দল রাতের টহল, বড় জাহাজ এড়াতে রাডার সিস্টেমের ব্যবহার এবং লাইফ ভেস্ট ও অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের অবস্থান সম্পর্কে প্রোটোকল ব্যাখ্যা করে।

যাত্রীদের জলপান করতে এবং সমুদ্রপীড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ঔষধ ও লেবু সঙ্গে আনতে পরামর্শ দেওয়া হয়।

ভাড়ার হার জাহাজের ধরন এবং সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। ডিজেল চালিত দ্রুত ইয়টগুলো প্রায় আট ঘন্টায় সাইপ্রাস পার করে। একজন যাত্রী বলেছেন, তার কাছ থেকে একটি স্থানের জন্য ৬ হাজার শেকেল (প্রায় ১ হাজার ৭১০ ডলার) চাওয়া হয়েছে, যা অন্যদের দেওয়া দামের দ্বিগুণ।

সব ইয়টের সঠিক লাইসেন্স নেই। একজন বাণিজ্যিক ইয়ট মালিক বলেছেন, কিছু অপারেটর যাত্রীদের জন্য বীমা না থাকা সত্ত্বেও আসনের জন্য চার্জ নিচ্ছেন। মারিনার একটি কোম্পানি জানিয়েছে যে তারা প্রতিদিন পাঁচটি পর্যন্ত ইয়ট চালাচ্ছে, তবে এটি এখনও চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।

যে কৃত্রিম রাষ্ট্র ইসরায়েলের শুরু হয়েছিল সাইপ্রাস হয়ে অভিবাসীদের আগমণের মাধ্যমে। সেই সাইপ্রাস দিয়েই কি তবে হলো তাদের শেষের শুরু?

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫