আলোচনা নাকচের পর ইরানের ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫, ১২:২৮

স্যাটেলাইট ছবিতে ইরানের ইসফাহান পরমাণু কেন্দ্র। ছবিটি ২৯ মার্চ, ২০২৫ তারিখের।
তেহরান পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা নাকচ করার একদিন পর, শনিবার ভোরে ইরান ও ইসরায়েল নতুন করে পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়েছে।
ইউরোপ যখন শান্তি আলোচনা চালু রাখার চেষ্টা করছে, তখনই এ সংঘর্ষ শুরু হয়।
ইরানের বার্তা সংস্থা ফার্স এর বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, ইসরায়েল ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করেছে—যা দেশের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। তবে কোনো বিপজ্জনক পদার্থের নিঃসরণ ঘটেনি।
ইরানি সংবাদমাধ্যম বলছে, ক্বোম শহরের একটি ভবনেও ইসরায়েলি হামলা হয়, যেখানে একজন ১৬ বছর বয়সী কিশোর নিহত এবং আরও দুইজন আহত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানায়, তারা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ ও উৎক্ষেপণ স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে একযোগে আক্রমণ চালিয়েছে।
পাল্টা হামলা হয়েছে ইসরায়েলেও। শুক্রবার রাত ২টা ৩০ মিনিটের কিছু পর ইসরায়েলি বাহিনী ইরান থেকে আসা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সতর্কতা দেয়। এর ফলে তেল আবিবসহ মধ্য ইসরায়েলের বিভিন্ন এলাকায় এবং দখলকৃত পশ্চিম তীরে সাইরেন বাজতে থাকে।
তেল আবিবের আকাশে দেখা গেছে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার আলোর রেখা। বিস্ফোরণের শব্দ সারা শহরে প্রতিধ্বনিত হয়, কারণ ইসরায়েল তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করে।
ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলেও সাইরেন বেজেছে বলে জানিয়েছে জাতীয় জরুরি সেবা ম্যাগেন ডেভিড অ্যাডম।
দেশটির সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানান, ইরান পাঁচটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, তবে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হেনেছে বলে প্রমাণ মেলেনি।
ইসরায়েলে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
জরুরি সেবা সংস্থা একাধিক ছবি প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা গেছে একটি বহুতল ভবনের ছাদে আগুন জ্বলছে। স্থানীয় গণমাধ্যম বলছে, প্রতিহত করা ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ থেকেই এ আগুন লেগেছে।
পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বিরোধ
১৩ জুন থেকে ইসরায়েল ইরানে হামলা শুরু করে, দাবি করে যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে। ইরান বলে, তাদের কর্মসূচি শুধুই শান্তিপূর্ণ। ইরান পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়।
ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র থাকার ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে ধারণা থাকলেও, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে তা স্বীকার বা অস্বীকার করে না।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাকটিভিস্টস নিউজ এজেন্সি জানায়, ইসরায়েলি হামলায় ইরানে এখন পর্যন্ত ৬৩৯ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে রয়েছে সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা এবং পারমাণবিক বিজ্ঞানীরা।
শুক্রবার ইরান জানায়, ইসরায়েলি হামলার মধ্যে তারা তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কোনো আলোচনায় বসবে না। ইউরোপের মধ্যস্থতায় আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি।
অন্যদিকে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানায়, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ২৪ জন ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
রয়টার্স স্বাধীনভাবে উভয় পক্ষের হতাহতের সংখ্যা যাচাই করতে পারেনি।
ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া
শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ইরান ‘সপ্তাহ দুয়েক, বা সর্বোচ্চ কয়েক মাসের মধ্যে’ পারমাণবিক অস্ত্র পেয়ে যেতে পারে।
তিনি নিউ জার্সির মোরিসটাউন বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা তা হতে দিতে পারি না।”
তিনি বলেন, তার জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড ভুল করেছেন, যিনি বলেছিলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে এমন প্রমাণ নেই।
ইরান বহুবার তেল আবিবকে লক্ষ্য করেছে—যেখানে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের বাস, এটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল।
ইসরায়েল বলছে, তারা শুক্রবার দিনে ডজনখানেক সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে ছিল ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র, তেহরানে পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ও পশ্চিম ও মধ্য ইরানের সেনা স্থাপনা।
কূটনীতি ও জেনেভা আলোচনার অগ্রগতি কম
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি বলেছেন, ‘ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ না হলে’ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো আলোচনা সম্ভব নয়। যদিও শুক্রবার তিনি ইউরোপীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিতে জেনেভায় পৌঁছেছেন।
ইউরোপ আলোচনার পথ খোলা রাখতে চায়।
ট্রাম্প বলেন, তিনি সিদ্ধান্ত নিতে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ সময় নেবেন, “দেখব মানুষ সোজা হয় কি না।”
তিনি বলেন, ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ বন্ধ করতে বলা এখন ‘খুব কঠিন’।
“যদি কেউ জিতে যায়, তখন বলা কঠিন হয়ে যায় থামতে। তবে আমরা প্রস্তুত, কথা বলছি ইরানের সঙ্গে, দেখব কী হয়।”
জেনেভার আলোচনায় তেমন অগ্রগতি হয়নি। ট্রাম্প বলেন, তিনি মনে করেন না আলোচকরা যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে পারবেন।
“ইরান ইউরোপের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। তারা আমাদের সঙ্গে চায়। ইউরোপ এটা পারবে না,” বলেন ট্রাম্প।
জাতিসংঘে উত্তেজনা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একটি কূটনৈতিক তারবার্তা অনুসারে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর শত শত মার্কিন নাগরিক ইরান ছেড়েছেন।
জাতিসংঘে ইসরায়েলি প্রতিনিধি ড্যানি ড্যানন নিরাপত্তা পরিষদকে বলেন, “ইরানের পারমাণবিক হুমকি সম্পূর্ণরূপে নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত আমরা হামলা বন্ধ করব না।”
ইরানের রাষ্ট্রদূত আমির সাঈদ ইরাভানি নিরাপত্তা পরিষদের পদক্ষেপ চেয়েছেন এবং বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের অংশ হলে তেহরান অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।
রাশিয়া ও চীন তাৎক্ষণিক উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে।
রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণে সীমা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা করতে রাজি, তবে এখন ইসরায়েলি হামলার মধ্যে আমরা সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা মেনে নেব না।”