আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজ ও জাপানি সাবমেরিনের আলু যুদ্ধ!

আবিদ চৌধুরী
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫, ১৪:৩১

সাবমেরিন এমন এক যুদ্ধযান, যার জন্য ‘জলযুদ্ধের গেরিলা’-এই বিশেষণই বোধ হয় সঠিক। নৌযুদ্ধের চিরাচরিত হিসাব-নিকাশ বদলে দেওয়া যুদ্ধযানটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ‘মিত্র ও অক্ষ’ দুই শক্তিরই স্বস্তি এবং অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরে সাবমেরিনের হানায় দুই পক্ষের বহু যুদ্ধজাহাজ ডুবেছে সে সময়। বহু সাবমেরিনেরও সলিল সমাধি ঘটেছে ডুবন্ত অবস্থায়। প্রশান্ত মহাসাগরে জাপান-আমেরিকার ‘যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনের’ সংঘর্ষ ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু ১৯৪৪ সালে ‘ইউএসএস ও’ব্যানন নামের একটি ফ্লেচার ক্লাস ডেস্ট্রয়ার এবং জাপানি RO-34 Kaichū VI ক্লাস সাবমেরিন’-এর মাঝে সংঘটিত হয় অদ্ভুত এক যুদ্ধ।
আমেরিকার ইউএসএস ও’ব্যানন ফ্লেচার ক্লাস ডেস্ট্রয়ারটি প্রধানত যুদ্ধে নিযুক্ত রসদ সাপ্লাই জাহাজগুলোকে এসকর্ট দেওয়ার কাজে নিয়োজিত ছিল। এমনই এক এসকর্ট মিশন শেষে ঘাঁটিতে ফিরে যাওয়ার পথে অন্ধকার রাতে কাকতালীয়ভাবে জাপানি সাবমেরিন RO-34 এর মুখোমুখি হয়ে পড়ে। যদিও ওই অঞ্চলটি প্রায় মার্কিন যুদ্ধজাহাজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে ছিল। ফলে জাপানি সাবমেরিনের উপস্থিতির কোনো আশঙ্কাই ছিল না।
জাপানি সাবমেরিন RO-34 তখন পানির ওপরে ছিল। প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সংগ্রহ এবং ব্যাটারি চার্জ করার জন্য এটি পানির ওপরে এসেছিল। মার্কিন যুদ্ধজাহাজ থেকে নিজেদের আড়াল করতে ইঞ্জিন বন্ধ রেখেছিলেন সাবমেরিনটির ক্রুরা। তাই ডেস্ট্রয়ার ও’ব্যাননের সাবমেরিন শনাক্তকারী সোনার সিস্টেম প্রথমে RO-34 কে অনেক নেভাল মাইনের লেয়ার হিসেবে খুবই কম দূরত্বে শনাক্ত করে। প্রতিপক্ষের যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করতে সাগরে অল্প গভীর পানিতে মাইন পেতে রাখা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার তখন। জাপানি আক্রমণ থেকে বাঁচতে ইউএসএস ও’ব্যানন নেভিগেশন লাইট বন্ধ করে চলতে থাকায় সাবমেরিনের অন্য ক্রুরা মার্কিন যুদ্ধজাহাজের আগমন টের পায়নি। সাবমেরিনের বদ্ধ অবস্থা থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়ে ডেকের ওপর বেশ কয়েকজন জাপানি নাবিক ঘুমাচ্ছিলেন। সার্চলাইট জ্বালিয়ে ও’ব্যাননের ক্রুরা যখন বুঝতে পারে, এটি একটি স্থির ভাসমান সাবমেরিনÑতখন সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য ডিফেন্সিভ ম্যানুভার হিসেবে তড়িঘড়ি হার্ডশিপ টার্ন নিতে শুরু করে তারা। কিন্তু তার পরও সাবমেরিনের সঙ্গে জাহাজের মৃদু সংঘর্ষ ঘটে যায়। দুটি নৌযানই সমান্তরালভাবে একই দিকে চলতে থাকে। দুটো নৌযান পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা স্বাভাবিকভাবেই অস্ত্র ছিল না (নৌ সদস্যরা জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া জাহাজে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেন না, অস্ত্রের মজুদ অস্ত্রাগারে থাকে)।
এমন পরিস্থিতিতে ডেস্ট্রয়ারের একজন ক্রু, যিনি কি না জাহাজে রাঁধুনির কাজ করতেনÑতাৎক্ষণিক এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেন। রান্নাঘর থেকে কয়েক বস্তা আলু এনে জাপানি সাবমেরিনের ডেকের ওপর থাকা ক্রুদের দিকে একের পর এক নিক্ষেপ করতে থাকেন! রাঁধুনির দেখাদেখি জাহাজের অন্য ক্রুরাও সাবমেরিনের ডেকে ফায়ারিংরত ক্রুদের উদ্দেশে আলু নিক্ষেপ করতে শুরু খেতেই তাৎক্ষণিক ধাক্কা সামলে উঠে শত্রু বধ করতে উভয় পক্ষ লড়াই শুরু করে। জাপানি সাবমেরিনের ডেকের ওপর ছিল একটি তিন ইঞ্চি ব্যাসের কামান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সাবমেরিনে টর্পেডো, নেভাল মাইন ছাড়াও ‘ডেক গান’ নামে পরিচিত এসব সারফেস ওয়েপন থাকত। ফলে এসব সাবমেরিনের উপকূলীয় এলাকা, অন্যান্য জাহাজ এবং যুদ্ধবিমান আক্রমণ করার ক্ষমতা রাখত। জাপানি সাবমেরিনের কামান থেকে ফায়ারিং শুরু হলো। কিন্তু সেটি ও’ব্যাননের মতো ডেস্ট্রয়ার শ্রেণির যুদ্ধজাহাজ ডোবানোর জন্য যথেষ্ট নয়। দূরত্ব খুবই কাছাকাছি হওয়ায় ইউএসএস ও’ব্যানন নিজের শক্তিশালী পাঁচ ইঞ্চি ব্যাসের কামান ব্যবহার করতে পারছিল না। আবার জাহাজের ক্ষতির আশঙ্কায় সাবমেরিন বিধ্বংসী টর্পেডো বা ডেপথ চার্জও ফায়ার করতে পারছিল না। একই অবস্থা ছিল সাবমেরিনের, তারাও নিজেদের মূল অস্ত্র টর্পেডো ছুড়তে পারছিল না। তাই সাবমেরিনটি মাইন নিক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কারণ ইউএসএস ও’ব্যাননের কোর্স এমন ছিল, সাবমেরিন থেকে মাইন নিক্ষেপ করলে সেটির ফাঁদে মার্কিন যুদ্ধজাহাজটি যে পড়বে, তা একদম নিশ্চিত। একজন জাপানি অফিসার তার রিভলবার দিয়ে গুলিও চালাতে থাকেন।
মার্কিন নাবিকদের সঙ্গে তখন করেন। সাবমেরিনের ক্রুরা রাতের অন্ধকারে মার্কিন জাহাজের অপর্যাপ্ত আলোতে ও লড়াইয়ের উত্তেজনাবশত আলুকে গ্রেনেড ভেবে বসে। জাপানি নাবিকদের কেউ কেউ স্বাভাবিক রিফ্লেক্সের বশে আলু ধরে ধরে পানিতে ফেলছিল, কেউ কেউ সাহস করে আমেরিকান যুদ্ধজাহাজের দিকে গ্রেনেড ভেবে আলু নিক্ষেপ করছিল! এরই মধ্যে জাপানি ক্যাপ্টেন ইমার্জেন্সি ডাইভ দেন পানির গভীরে। এবার মার্কিন যুদ্ধজাহাজের ক্যাপ্টেন অ্যান্টি সাবমেরিন ডেপথ চার্জ নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। পানির নিচে সাবমেরিনকে প্রচণ্ড পানির চাপ সহ্য করতে হয় এবং সাবমেরিন ধীরে ধীরে চাপ সহ্য করে পানির গভীরে যায়।
প্যাসকেলের সূত্র অনুযায়ী, গভীরতা বাড়লে চাপ বাড়ে। সাবমেরিন নির্দিষ্ট পরিমাণ চাপ সহ্যক্ষমতা সম্পন্ন করে বানানো, ফলে নির্দিষ্ট গভীরতার বেশি গভীরে সাবমেরিন যেতে পারে না। কোনো কারণে যদি এই চাপের পরিমাণ হঠাৎ বাড়িয়ে-কমিয়ে দেওয়া যায়, তবে সাবমেরিন পানির চাপে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবে। আর সে কাজটি করে ডেপথ চার্জ। এটি পানির নিচে গিয়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায়, আর বাকি কাজটুকু করে দেয় পানির চাপ।
সেদিন মার্কিন যুদ্ধজাহাজের ছোড়া এসব ডেপথ চার্জের প্রচণ্ড বিস্ফোরণে জাপানি সাবমেরিনের সলিল সমাধি ঘটেছিল। নিহত হয়েছিলেন ৬৬ জন জাপানি নাবিক। সাবমেরিনটির কাউকেই জীবিত উদ্ধার করা যায়নি। আলুকে গ্রেনেড না ভেবে সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন যদি পানির গভীরে ডাইভ না দিতেন, তবে আমেরিকার যুদ্ধ জাহাজের ডেপথ চার্জ ফায়ার করা সম্ভব হতো না। হয়তো উভয় পক্ষ অলিখিত সন্ধি করে নিরাপদে নিজেদের সরিয়ে নিত। এ ঘটনায় ইউএসএস ও’ব্যানন বেশ আলোচিত হয়। আলুর লড়াইয়ের গল্পটি নাবিকদের মুখেমুখে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বয়স হয়ে যাওয়ায় ১৯৭০ সালে আমেরিকান এই যুদ্ধজাহাজটিকে স্ক্র্যাপ করে ফেলা হয়।