বোম্বার ‘বি-টু’ ও বাঙ্কার বিধ্বংসী ‘জিবিইউ-৫৭এ/বি’ কেন অনন্য?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫, ১২:১৭

দূরপাল্লার স্টিলথ যুদ্ধবিমান ও বাঙ্কার বিধ্বংসী বোমা বিশ্বের যেকোনো স্থানে হামলা চালানোতে সক্ষম করে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীকে।
পাথু্রে পাহাড়ের নিচে ইরানের ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় ‘বি-টু স্পিরিট’ দূরপাল্লার বোমারু বিমান ও ‘জিবিইউ-৫৭এ/বি’ বাঙ্কার বিধ্বংসী বোমা দিয়ে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
প্রায় নয় দিন হতে চলল- ইরানে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। অথচ ফোরদোতে আঘাত হানতে ঠিকই তাদের চেয়ে থাকতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের এই দুই বিধ্বংসী সমরাস্ত্রের দিকে। এর কারণ- কিছু বৈশিষ্ট্য যুদ্ধের ময়দানে তাদের অনন্য করে তুলেছে।
বি-টু স্পিরিট বোম্বার
বি-টু স্পিরিট- যাকে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত স্টিলথ বোম্বার বলা হয়, প্রথমবার জনসমক্ষে আসে ১৯৮৯ সালে। এটি নির্মাণ করেছে নর্থরপ গ্রুম্যান। ১৯৯৭ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর কার্যক্রমে যুক্ত হয়।
চতুর্থ প্রজন্মের বোমারু বিমান হলেও এর বিশেষত্ব হচ্ছে এর ‘ফ্লাইং উইং’ নকশা- যেটা রাডার রশ্মি প্রতিফলিত না করে শোষণ করে ফেলে। এর ফলে এই বিমানকে চিহ্নিত করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
এই স্টিলথ বোম্বার এমনভাবে ডিজাইন করা যে, শত্রুপক্ষ না জেনে এটি গভীর রাতের অন্ধকারে ঢুকে যেতে পারে শত্রুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে।
বোম্বারটির বডি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল ও রাডার-অ্যাবজর্বেন্ট ম্যাটার, যেগুলো বিমানের রাডার সিগনেচারকে নাটকীয়ভাবে কমিয়ে দেয়।
বি-টু এমনকি অত্যন্ত সুরক্ষিত বিমানঘাঁটি, পারমাণবিক ইনস্টলেশন, গভীর বাঙ্কার, এবং অন্যান্য কৌশলগত স্থাপনাকে সফলভাবে টার্গেট করতে সক্ষম।
এ ছাড়া বি-টু স্পিরিট বহু দূরের আকাশপথ পাড়ি দিতে সক্ষম। এয়ার-টু-এয়ার রিফুয়েলিংয়ের মাধ্যমে ১০ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারে। যুদ্ধবিমানটিতে আছে পাইলটদের জন্য প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থাও। খাবার গরম করার জন্য আছে- মাইক্রোওয়েভ ওভেন।
সামরিক ব্লগাররা দাবি করছেন, ইরানে যেসব বি-টু বোমারু বিমান হানা দিয়েছে- তা যুক্তরাষ্ট্র থেকেই আকাশে উড়েছে। এমনকি সেগুলো ৩৭ ঘণ্টা আকাশে ছিল। তাদের দাবির সত্যতা যাচাই করা না গেলেও প্রযুক্তিগত ভাবে এটি সম্ভব।
এই বিমানের অস্ত্র বহনের ক্ষমতা ৪০ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত। এটি পরমাণু বোমা থেকে শুরু করে প্রচলিত বাঙ্কার ধ্বংসকারী বোমা পর্যন্ত বহন করতে পারে।
বাঙ্কার বিধ্বংসী ‘জিবিইউ-৫৭এ/বি’
পরমাণু বোমার পাশাপাশি বি-টু স্পিরিট বোমার অস্ত্র ভান্ডারে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হলো ‘জিবিইউ-৫৭এ/বি’ যেটিকে যেটিকে ম্যাসিভ ওর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর বা এমওপি নামেও ডাকা হয়। এটি মূলত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কনভেনশনাল বাঙ্কার-ব্লাস্টার বা বাঙ্কার-বিধ্বংসী বোমা।
এই বোমাগুলোর ওজন প্রায় ৩০ হাজার পাউন্ড এবং এটি ২০ ফুটেরও বেশি দীর্ঘ। বোমাটি তৈরি করা হয়েছে এমনভাবে যাতে এটি শত শত ফুট গভীর মাটির নিচে ঢুকে শক্তিশালী কংক্রিট বাঙ্কার ধ্বংস করতে পারে।
বোমাটিতে রয়েছে জিপিএস-নির্ভর স্মার্ট গাইডেন্স সিস্টেম। যার মাধ্যমে এটি অত্যন্ত নির্ভুলভাবে লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে। এর ভেতরে রয়েছে ৫ হাজার ৩০০ পাউন্ডের উচ্চ ঘনত্বযুক্ত বিস্ফোরক উপাদান। বোমাটি এতটাই ভারী এবং শক্তিশালী যে এটি ২০০ ফুটেরও বেশি মাটি ভেদ করে ১৮ মিটার কংক্রিটের দেয়াল পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দিতে পারে।
এমওপি বোমার জন্ম হয়েছিল এমন একটি চিন্তা থেকে- যেখানে প্রচলিত অস্ত্র দিয়ে শত্রুর পাহাড় বা গভীর পাহাড়ি গুহায় নির্মিত বাঙ্কারগুলো ধ্বংস করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে ইরান, উত্তর কোরিয়া বা সিরিয়ার মতো দেশগুলোর কিছু ইনস্টলেশন এতটাই গভীরে ও মজবুতভাবে স্থাপিত- যেখানে প্রচলিত বোমা কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। সেই চিন্তা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এমওপি তৈরিতে হাত দেয়।
এই বোমা শুধু বি-টু স্টিলথ বোম্বার থেকেই ফেলা সম্ভব, কারণ অন্য কোনো বিমান এটি বহন করতে পারে না। বি-৫২ বা বি-১ এর মতো বড় হেভি বোম্বারও এই বোমার জন্য উপযুক্ত নয়, কারণ তাদের স্ট্রাকচার এবং পেলোড লিমিট এমওপি বহনের জন্য যথেষ্ট নয়।
বি-টু’র পেলোড বে দুটি। প্রতিটিতে একটি করে এমওপি বহন করা যায়।
জিবিইউ-৫৭এ/বি বোমার আরেকটি দিক হলো, এটি প্রি-প্রোগ্রামড। অর্থাৎ, আকাশে থাকা অবস্থায় এটি স্যাটেলাইট সংযোগের মাধ্যমে নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করে নিতে পারে। এটি ‘পেনিট্রেশন’ এবং ‘ডিলেইড ডেটোনেশন’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
অর্থাৎ, এটি প্রথমে ভূগর্ভস্থ লক্ষ্যবস্তুর গভীরে ঢুকে যায়। তারপর নির্দিষ্ট সময় পরে বিস্ফোরণ ঘটায় যাতে কাঠামোর সবচেয়ে ভিতরের অংশে বেশি ক্ষতি হয়।
তবে সব সুবিধার পরেও এই বোমার সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। শত্রু যদি জিপিএস জ্যামার বা স্পুফিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে, তাহলে এর লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আবার যদি বাঙ্কারগুলো আরও গভীরে ও সুরক্ষিতভাবে নির্মিত হয়, তবে এমওপি আংশিকভাবে সফল হতে পারে। এ ছাড়া এর নির্মাণ ব্যয় খুবই বেশি। বিলিয়ন ডলারের তৈরি বোম্বার বি-টুর ক্ষেত্রেও তাই। শুধু তাই নয়- যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র গুটিকয়েক ঘাঁটিতে বি-টু রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা আছে।