বি-টু স্পিরিট: ‘ধরা যায় না ছোঁয়া যায় না’ যে যুদ্ধ বিমান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫, ১৫:১৩

যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ২১টি বি-টু যুদ্ধবিমান আছে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। এই ধরনের বিমান আর কারও কাছে নেই।
বৈজ্ঞানিক কল্পকথার আকাশযানের মতো দেখতে অনেকটা। কিছুটা কিম্ভূতকিমাকার, একই সঙ্গে নান্দনিক সেই সঙ্গে ভয় জাগানিয়া নকশা।
আধুনিক ও ভীষণ কার্যকর অন্যান্য যুদ্ধবিমানের তুলনায় ইরানে আঘাত করা যুক্তরাষ্ট্রে বি-টু স্পিরিট ডিজাইনের কারণে যা রাডারে প্রায় অদৃশ্য করে তোলে।
এটি সামরিক বিমানের মধ্যে সত্যিই আলাদা ও বিশেষ এবং বিশ্বে সবচেয়ে দামি। প্রতিটির মূল্য দুই বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এগুলো বানানো হয়েছে অল্প কয়েকটি, কখনও কোনো যুদ্ধে হারায়নি, কেবল একটি দুর্ঘটনায় পড়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম সিএনএনের জাকোপো প্রিস্কো ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি এই যুদ্ধ বিমানের বিশেষত্ব নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।
তাতে লেখা, ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে শীতল যুদ্ধের সময় এর নকশা করা হয়েছিল রুশ বিমান প্রতিরক্ষা ভেদ করা এবং পরমাণু অস্ত্র বহনের জন্য।
কিন্তু এর প্রথম উড্ডয়নের মাত্র কিছুক্ষণ পরে ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর পতনের মাধ্যমে শীতল যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। এরপর থেকে কোনো বি-টু রাশিয়ার আকাশে উড়ে যায়নি।
তবুও এটি যথেষ্ট যুদ্ধ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে।
১৯৯৩ সালে মিজৌরির হোয়াইটম্যান এয়ার ফোর্স বেসে বি-টু বিমান সরবরাহ করা হয়। যেখানে এখনও সেগুলো কার্যকরী আছে এবং অপারেট করে। এর প্রথম যুদ্ধকালীন ব্যবহার হয়েছিল ১৯৯৯ সালের কসোভো যুদ্ধে।
বি টু পৃথিবীর যেকোনো স্থানে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছে এবং আবার বেসে ফিরতে পারে, মাঝে মাঝে আকাশে রিফুয়েলিং করে। কোনো বি-টু যুদ্ধকালীন অবস্থায় হারানো যায়নি।
অ্যারোস্পেস বিশেষজ্ঞ রেবেকা গ্রান্ট বলেছেন, “এটি সত্যিই এক ধরনের বিশেষ কিছু, অন্য কোনো বিমানের মতো নয়।"
এই বিশেষজ্ঞ নিজে বিমানে চড়েছেন। তিনি বলেন, “ককপিট থেকে দেখা গেলে, ফ্লাইং উইং খুবই স্বতন্ত্র। এটি খুবই বিশেষ – যেন একটি জীবন্ত সত্তা, শুধু একটা সাধারণ বিমান নয়। হয়ত এ কারণেই সব বি-টুকে ব্যক্তিত্বশীল ধরা হয়।”
একে প্রায়ই নারী বোঝাতে শি বলে ডাকা হয়।
লো অবজারভেবল প্রযুক্তি
বি-টু হলো তিনটি কৌশলগত বোমার বিমানের একটি, যা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনীতে সেবায় রয়েছে। বাকি দুটি হল
দ্রুতগামী রকওয়েল বি-ওয়ান ল্যান্সার, যার প্রথম উড়ান হয়েছিল ১৯৭৪ সালে; এবং বিশালাকৃতি বোয়িং বি-ফিফটি টু স্ট্র্যাটোফর্ট্রেস, ১৯৫০-এর দশকের একটি কিংবদন্তি বিমান, যেটিকে তখন থেকেই ধারাবাহিকভাবে আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
বি-ফিফটি প্রথমবারের মতো বোমার বিমানকে অনেক উঁচু উচ্চতায় ওড়ানোর ধারণা দেয় যাতে শত্রুর অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট মিসাইলগুলো সহজে এতে পৌঁছাতে না পারে।
আর বি-ওয়ান নেয় সম্পূর্ণ বিপরীত কৌশল: খুব নীচু ও খুব দ্রুত গতিতে উড়ে রাডারের ধরা পড়া এড়ানোর চেষ্টা করে।
কিন্তু এই দুই কৌশলই নিখুঁত ছিল না এবং কোনোটিই শত্রুর আক্রমণ থেকে পুরোপুরি নিরাপদ ছিল না। তখনকার শীতল যুদ্ধের উত্তেজনা চাইছিল একটি চূড়ান্ত পরমাণু প্রতিরোধ ব্যবস্থা— এমন একটি বোমার বিমান, যা পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে সক্ষম হবে এবং একই সঙ্গে শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কাছে প্রায় অদৃশ্য থাকবে।
এই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয় ১৯৭০-এর দশকে, স্টেলথ প্রযুক্তির আবির্ভাবের মাধ্যমে। এটি একগুচ্ছ প্রযুক্তি, যা কোনো বিমানকে রাডারে খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন বা প্রায় অসম্ভব করে তোলে।
“এটি ছিল শীতল যুদ্ধের একটি পণ্য, কিন্তু একই সঙ্গে বিমানকে স্টেলথ বা অদৃশ্যভাবে ডিজাইন করার একটি বড় প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফল”, বলেন গ্রান্ট।
“বি-টি বিমানের লক্ষ্য ছিল রুশ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়া—তাদের সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল এবং শীর্ষ মানের ফাইটার বিমান দুটিকেই। আর এখনো এই বিমানটির একই মিশন—যেখানেই শত্রুর সবচেয়ে উন্নত প্রতিরক্ষা থাকুক না কেন, সেটিকে ফাঁকি দেওয়া।”
এটি করার জন্য এই বিমানে রয়েছে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, যেগুলোর অনেকটাই গোপন এবং যেগুলো বিমানটিকে দৃষ্টির আড়ালে রাখতে সাহায্য করে।
“প্রথমত হলো এর আকৃতি, যা রাডার প্রতিফলন পরিবর্তন করে,” বলেন গ্রান্ট।
রাডার ধাঁধা
রাডার আবিষ্কৃত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। এটি কাজ করে আকাশে শক্তির একটি পালস পাঠিয়ে, তারপর সেটি কোনো বস্তু (যেমন বিমান) থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে — এই প্রতিফলনের তীব্রতা ও কোণ দেখে বস্তুটির আকার ও অবস্থান নির্ণয় করা যায়।
অন্যান্য বিমানের মতো বি-টু-এর কোনো বড় উল্লম্ব অংশ নেই, যেমন লেজ, যা রাডার তরঙ্গ প্রতিফলিত করতে পারে।
আসলে এর মসৃণ পৃষ্ঠ এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন রাডার তরঙ্গগুলোকে পুরোপুরি ছড়িয়ে দেয়, যাতে প্রায় কোনো তরঙ্গ উৎসে ফিরে না যায় — ফলে বিমানটিকে একটি পাখির মতো ছোট দেখায়।
এই বিষয়টি রুশ পদার্থবিজ্ঞানী পিয়োতর উফিমৎসেভ ১৯৬২ সালের একটি বইয়ে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। তাই প্রকাশের অনুমতি দেয়।
“এছাড়াও এতে রয়েছে রাডার শোষণকারী প্রলেপ ও উপকরণ, এবং বিমানের ইঞ্জিনগুলো চোখে পড়ে না, কারণ সেগুলো লুকানো আছে বিমানের পিছনের অংশে, যেন তাপ চিহ্ন তৈরি না হয়”, বলেন গ্রান্ট।
তাপ চিহ্ন মানে হলো আকাশে বিমানের উপস্থিতির একটি স্পষ্ট প্রমাণ, আর বি-টু-এর নকশাকাররা এটিকে আড়াল করতে ব্যাপক চেষ্টা করেছেন। তারা এমনকি ইঞ্জিনের এক্সহস্টের কাছে তাপ শোষণকারী একই ধরনের টাইলস ব্যবহার করেছেন, যেগুলো স্পেস শাটলকে পুনঃপ্রবেশের সময় সুরক্ষা দিত।
বিমানে একটি অন-বোর্ড সিস্টেম আছে, যা ক্রুদের সতর্ক করে যদি বিমানটি কনট্রেইল তৈরি করে। অর্থাৎ যখন বিমানের এক্সহস্ট গ্যাসের চারপাশে বরফ কণাগুলো মিলে বাষ্পের রেখা তৈরি হয়। এতে তারা উচ্চতা পরিবর্তন করতে পারে।
সবশেষে, বি-টু অত্যন্ত নীরব — একে শুধু শোনা যায় যখন এটি মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে।
এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সমষ্টিগত নাম ‘লো অবজারভেবল’ প্রযুক্তি। তবে এগুলো সব সময় সক্রিয় থাকে না — বিমানের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলে তখনই এগুলো চালু করা হয়।
অন্যান্য বিষয় ছাড়াও, পাইলটদের ককপিটে থাকা ‘PEN’ লেখা একটি বোতাম চাপতে হয়, যাতে শত্রু প্রতিরক্ষা ভেদ করা যায়।
“অন্য সব যুদ্ধবিমানের মতো, যখন আপনি শত্রুর হুমকির কাছাকাছি যান, তখন প্রতিরক্ষা ভেদ করতে প্রস্তুতি হিসেবে অনেক কিছু করতে হয়। তারা পুরো প্রক্রিয়াটি বলে না, কিন্তু এটা সত্যি — টার্গেট এলাকার কাছে গেলে তারা স্টেলথ মোডে চলে যায়”, বলেন গ্রান্ট।
আকাশে দুই দিন
বি-টু-এর কিছু মিশন টানা ৪৪ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছে। ২০০১ সালে, মিসৌরি থেকে আফগানিস্তানে, অপারেশন ইনডিউরিং ফ্রিডম চলাকালে এমনটি দেখা যায়।
এ কারণে ককপিটের পেছনে একটি সমতল জায়গা থাকে যেখানে দুই পাইলটের একজন বিশ্রাম নিতে পারেন। পাশাপাশি খাবার সংরক্ষণ ও গরম করার সুবিধা এবং একটি টয়লেট রয়েছে।
বিমান দুর্ঘটনা ও রক্ষণাবেক্ষণ
কোনো বি-টু কখনও যুদ্ধে হারায়নি। এমনকি এই বিমানে কোনো আত্মরক্ষামূলক অস্ত্রও নেই। তবু একটি বিমান ২০০৮ সালে একটি দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়ে যায়। সেটি গুয়ামের অ্যান্ডারসেন বিমানঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পরপরই ভেঙে পড়ে। পাইলটরা অবশ্য নিরাপদে বেরিয়ে আসেন।
আরেকটি ২০১০ সালে আগুনে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘ মেরামতের পর পুনরায় সেবায় ফিরে আসে।
সব বি-টু বিমানের নাম যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্যের নামে। শুধু ‘স্পিরিট অব অ্যামেরিকা’ এবং ‘স্পিরিট অব কিটি হক’ ব্যতিক্রম। এই বিমানগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন এমন বিমানের মধ্যে অন্যতম। প্রতি ঘণ্টার উড়ানের জন্য ১০ ঘণ্টারও বেশি সার্ভিসিং দরকার হয় এগুলোর।
বিমানের যে সংবেদনশীল আবরণ, যা অতিরিক্ত স্টেলথ প্রদান করে, সেটি ঠান্ডা তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। এজন্য প্রয়োজন এয়ার কন্ডিশনড হ্যাংগার, যা এর পরিচালন ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দেয়।
মূল্য ও উৎপাদন সংখ্যা
যে ২১টি বি-টু তৈরি করা হয়েছিল, তাদের প্রতিটিকে এই প্রকল্পের গবেষণা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত সমস্ত খরচ বহন করতে হয়েছে। তবে আরও বেশি সংখ্যক বিমান তৈরি করা হলে তুলনামূলকভাবে কমে যেত।
“এর ফলেই প্রতিটির মূল্য ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হয়েছে — যদি মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৩২টি বানানো হতো, তাহলে এটি অনেক বেশি যুক্তিসংগত হতো”, বলেন গ্রান্ট।
বি-টু বিমানের বহর ছোট এবং এর প্রযুক্তির অনেক অংশ গোপনীয়, তাই এটি ওড়ানোর সুযোগ পাওয়া একটি গৌরবের বিষয়। এখন পর্যন্ত মাত্র কয়েক শ পাইলট এই বিমানে চড়ার সুযোগ পেয়েছেন।
বছরের পর বছর ধরে এই বিমানের ফ্লাইট সিস্টেম, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অস্ত্রগুলো উন্নত করা হয়েছে। এটি এখনও যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু ত্রয়ীর একটি দৃঢ় অংশ। এর মধ্যে রয়েছে মহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও পানির নিচে থাকা সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র।
তবে এর দিন হয়ত গণনা করা শুরু হয়েছে — বি-টুর উত্তরসূরি ইতোমধ্যেই উন্নয়নে আছে। যার নাম বি-টোয়েন্টি ওয়ান রেইডার। এটি সম্পূর্ণ গোপনীয়তায় মোড়া এবং আশা করা হচ্ছে এটি ২০২৫ সালের পর কোনো এক সময় উন্মোচিত হবে।
নতুন বিমান একই ভূমিকা পালন করবে, কিন্তু ৪০ বছরের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি পুরোপুরি ব্যবহার করবে।