Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ট্র্যাজিক কমেডি: চুরি হয়েছিলেন চার্লি চ্যাপলিন!

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ১৬:২৯

ট্র্যাজিক কমেডি: চুরি হয়েছিলেন চার্লি চ্যাপলিন!

চার্লি চ্যাপলিন।

চলচ্চিত্রের ইতিহাসে চার্লি চ্যাপলিন এক কিংবদন্তি। হলিউডের নীরব চলচ্চিত্র যুগের এক হাস্যরসের সম্রাট। টুপির নিচে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, অদ্ভুত গোঁফ, বাঁকা লাঠি আর বিশেষ হাঁটার ভঙ্গি দিয়ে যিনি হাসিয়েছেন কোটি মানুষকে। নির্বাক চলচ্চিত্রের সময় শুধু মুখের অভিব্যক্তি, অদ্ভুত শারীরিক ভাষা আর ড্রেসআপ-গেটআপ দিয়ে চলচ্চিত্র জগতে আজীবনের জন্য এমন এক আসনে বসে আছেন মানুষটা, যা হয়তো আর কারো পক্ষেই ছোঁয়া সম্ভব নয়। তার জীবনের শেষ অধ্যায়ও যেন ছিল এক ধরনের ‘ট্র্যাজিক কমেডি’। মৃত্যুর পরও রেহাই পাননি  চার্লি। ১৯৭৮ সালে পৃথিবীব্যাপী শোরগোল ফেলে দিয়েছিল একটি ঘটনা, কবর থেকে চার্লি চ্যাপলিনের লাশ চুরি!

১৯৭৭ সালের ক্রিসমাসের দিনে  ৮৮ বছর বয়সে সুইজারল্যান্ডের ভেভে শহরে নিজের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন চ্যাপলিন। তার বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটেছিল শান্তিতে, তার প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে। পরবর্তী সময়ে তাকে লেক জেনেভার কাছে কর্সিয়ার-সুর-ভেভে (ঈড়ৎংরবৎ-ংঁৎ-ঠবাবু) গ্রামের ছোট এক কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়। তার ভক্ত এবং বিশ্বজুড়ে সিনেমাপ্রেমীরা তার প্রয়াণে শোকাহত হয়েছিলেন। তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে। 

কিন্তু এই শান্ত সমাহিত অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মাত্র তিন মাস পর, ১৯৭৮ সালের ২ মার্চ ঘটে রোমহর্ষক সেই ঘটনা। কবর থেকে চুরি হয়ে যায় স্যার চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিনের মৃতদেহ! হইচই পড়ে গেল পুরো সুইজারল্যান্ডে। কী কারণে কে বা কারা চুরি করল এই মহান মানুষটির মৃতদেহ, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ল সবাই। 

লাশ চুরির ঘটনাটি ঘটে গভীর রাতে। দুষ্কৃতকারীরা পরিকল্পনা করে কবর খুঁড়ে তুলে নেয় চ্যাপলিনের কফিন। পুরো এলাকা ছিল ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন, আর নিরাপত্তা ছিল একেবারেই শিথিল। চোরেরা শুধু কফিনটিই চুরি করে, কবরখানা আবার ঢেকে দেয় যাতে কেউ সহজে টের না পায়।

পরদিন সকালে কবরস্থানের কর্মীরা বিষয়টি টের পেয়ে পুলিশে খবর দেয়। সুইস পুলিশ তৎক্ষণাৎ তদন্তে নামে, কিন্তু একুশ শতকের গোড়ার দশকের মতো তখন প্রযুক্তির সেই সক্ষমতা ছিল না। তাই তদন্ত ছিল অনেকটাই ক্লাসিক পদ্ধতিতে, গোয়েন্দা নজরদারি, সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং গোপন টেলিফোন রেকর্ড শোনা। প্রাথমিকভাবে তাদের সামনে কোনো সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল না, কে বা কারা এমন জঘন্য কাজ করতে পারে এবং কেন? মুক্তিপণ আদায় করাই কি মূল উদ্দেশ্য ছিল, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো বিকৃত মানসিকতা কাজ করছিল? পুলিশ প্রতিটি দিক খতিয়ে দেখতে শুরু করে। কিন্তু কোনো কূলকিনারা পেল না কেউ।

একসময় রহস্যময় ফোন আসতে শুরু করল চ্যাপলিনের স্ত্রী ওনা চ্যাপলিনের কাছে। চ্যাপলিনের মৃতদেহের জন্য মুক্তিপণ হিসেবে ছয় লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক দাবি করে বসল ফোনকলার। ফ্রাঙ্ক দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বিষয়টি উড়িয়ে দেন ওনা। কিন্তু ব্যাপারটা আমলে নেয় পুলিশ। আশপাশের এলাকার মোট ২০০টি টেলিফোন বুথের ওপর নজর রাখা শুরু করে তারা। কিন্তু তাতেও দমানো যায়নি রহস্যময় ফোনকলকারীদের। চ্যাপলিনের দুই সন্তানকেও হুমকি দিতে থাকে তারা। 

অবশেষে টানা পাঁচ সপ্তাহ খোঁজাখুঁজির পর দুজন চোরকে আটক করে পুলিশ। একজন পোল্যান্ডের অধিবাসী, নাম রোমান ওয়ারডাস। পেশায় গাড়ির মেকানিক। অন্যজন বুলগেরিয়ার গ্যানসো জ্যানিব। তারাই চুরি করেছে চ্যাপলিনকে। কাজটা তারা করেছিল পেটের দায়ে। কবর থেকে লাশ চুরি করাই তাদের পেশা। চার্লি চ্যাপলিনের কঙ্কাল বিক্রি করে নিজেদের আর্থিক সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিল তারা। পুরো পরিকল্পনাটা ওয়ারডাসের। চোরদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, চ্যাপলিনের বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে ভেভের পার্শ্ববর্তী একটি ভুসি ক্ষেতের নিচে তারা কফিনটিকে কবর দেন। প্রায় ১১ সপ্তাহ পর, ১৭ মে, ১৯৭৮ তারিখে পুলিশ অবশেষে চার্লি চ্যাপলিনের লাশ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। মূল পরিকল্পনার জন্য ওয়ারডাসকে সাড়ে চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। গ্যানসো জ্যানিবের সাজা হয় ১৮ মাস।

চ্যাপলিনের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার পর ওনা চ্যাপলিন সিদ্ধান্ত নেন এবার যেন আর কোনোভাবেই লাশ চুরি না হতে পারে। নিজেদের পারিবারিক কবরস্থানে আবার সমাহিত করা হলো চ্যাপলিনকে। তবে এবার আর কোনো ঝুঁকি নয়। এবার কবরের চারপাশে কংক্রিট দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। যেন শত চেষ্টাতেও আর কেউ তা চুরি করতে না পারে।

চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন নির্বাক যুগের সবচেয়ে প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতা, কাহিনিকার। আর অভিনেতা হিসেবে তো আজও তিনি অদ্বিতীয়। ১৯২০ সালে যখন চলচ্চিত্র নির্বাক থেকে সবাক হলো, তখনো তিনি বানিয়েছেন একেকটি কালজয়ী সিনেমা। চার্লি চ্যাপলিন আমাদের এমন এক হাস্যরসের জগতে নিয়ে গেছেন, যেখানে দুঃখ-ব্যথাও পায় ছুঁয়ে যাওয়ার স্বস্তি। তার জীবনের শেষ অধ্যায় এমনকি মৃত্যুর পরের ঘটনাও যেন এক নিঃশব্দ সিনেমার চিত্রনাট্য। আজও এই কাহিনি মানুষকে চমকে দেয়, বিস্মিত করে, আবার একরাশ বিষাদের মাঝে এনে দেয় এক চিলতে ব্যঙ্গাত্মক হাসি, যেমনটি চ্যাপলিন নিজেই করতে পারতেন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫