Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ইরানে হামলা: মধ্যপ্রাচ্য পুনর্বিন্যাসের জায়নবাদী রূপরেখা

Icon

জেফ হ্যালপার

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ২৩:৩৯

ইরানে হামলা: মধ্যপ্রাচ্য পুনর্বিন্যাসের জায়নবাদী রূপরেখা

২১ জুন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র

জেফ হ্যালপার, একজন উপ‌নি‌বেশবি‌রোধী ইসরায়েলি নৃতাত্ত্বিক, যিনি ইসরায়েলি কমিটি অ্যাগেইনস্ট হাউস ডেমোলিশনসের (আইসিএইচডি) প্রধান এবং ওয়ান ডেমোক্রেটিক স্টেট ক্যাম্পেইনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি ‘ওয়ার অ্যাগেইনস্ট পিপল : ইসরায়েল, দ্য প্যালেস্টাইন অ্যান্ড গ্লোবাল প্যাসিফিকেশন’ (প্লুটো প্রেস, লন্ডন, ২০১৫) গ্রন্থের রচয়িতা। তার সর্বশেষ গ্রন্থ ‘ডিকলোনাইজিং ইসরায়েল, লিবারেটিং প্যালেস্টাইন: জায়নিজম, সেটেলার কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড দ্য কেইস ফর ওয়ান ডেমোক্রেটিক স্টেট’ প্রকাশিত হয় ২০২১ সালে (প্লুটো প্রেস, লন্ডন)। হ্যালপারের এই নিবন্ধটি নেওয়া হয়েছে কাউন্টার পাঞ্চ ডটকম থেকে। ভাষান্তর করেছেন শাহেরীন আরাফাত।

এই নিবন্ধে হ্যালপার যে বাস্তবতাকে সামনে আনেন, তা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি ও ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার ভবিষ্যৎকে ঘিরে এক শীতল ও নির্মম চিত্র এঁকে দেয়-যেখানে প্রতিরোধের প্রতিটি অভিব্যক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে স্বাভাবিকীকরণের মোড়কে জায়নবাদী প্রকল্পের চূড়ান্ত রূপায়ণ চলছে। এই কাঠামোর ভেতরে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ কেবলই একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়।

ওয়াশিংটনে তখন ২১ জুন সন্ধ্যা, জেরুজালেমে সকাল হয়েছে-যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। এই হামলা ইসরায়েলের আরো বিস্তৃত সামরিক অভিযানের অংশ, যার লক্ষ্য কেবল ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ধ্বংস করা নয়, বরং বেসামরিক অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দিয়ে ‘শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন’ ঘটানো। এই হামলার রয়েছে তিনটি কৌশলগত লক্ষ্য।

প্রথমত, ট্রাম্প প্রশাসন আবারও যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর বৈশ্বিক কর্তৃত্বের দাবি তুলেছে-যা ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিরই একটি পূর্বশর্ত। এই হামলা যদি কার্যত একতরফা, কম ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপর্যস্ত এক প্রতিপক্ষের ওপর কৌশলগত আঘাত হয়, তবুও তা প্রমাণ করে, ন্যাটো নেতৃত্বাধীন ক্ষমতার আধিপত্য বজায় রাখতে বলপ্রয়োগই এখনো মুখ্য উপায়। এটি ট্রাম্প-যুগের বহু আগের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিরই ধারাবাহিকতা।

দ্বিতীয়ত, এই হামলার মাধ্যমে ইসরায়েলের আঞ্চলিক কর্তৃত্ব পুনরায় নিশ্চিত করা হয়েছে, যেখানে তারা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা ও সম্প্রসারণের দায়িত্বে থাকা এক প্রক্সি শক্তি হিসেবে কাজ করে। এই বার্তাটি বিশেষভাবে জরুরি হয়ে ওঠে, যখন ইসরায়েল আন্তর্জাতিক মহলে ক্রমেই একঘরে হয়ে পড়ে এবং ৭ অক্টোবরের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাদের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে থাকে।

একইসঙ্গে, এই হামলা স্পষ্ট করে দেয়, ইসরায়েল কেবল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র নয়, বরং নিজস্ব কৌশলগত লক্ষ্য বাস্তবায়নে সক্ষম, স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি আঞ্চলিক শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি সত্ত্বেও ইরানে হামলা চালিয়ে, পরে সেই ‘জয়’ ট্রাম্পকে উপহার দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ইসরায়েলের স্বতন্ত্র ভূমিকাকে জোরদার করেন। যেমন জার্মান চ্যান্সেলর মেটজ বলেছিলেন, ‘ইসরায়েল আমাদের সবার পক্ষ থেকে নোংরা কাজটা করে দিচ্ছে।’

তৃতীয়ত, এই অভিযানের মাধ্যমে ইসরায়েল তাদের একমাত্র সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকে কৌশলগতভাবে নিষ্ক্রিয় করে মধ্যপ্রাচ্যে চূড়ান্ত সামরিক আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছে। একই সঙ্গে এটি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে শুরু হওয়া ‘আরব-ইসরায়েল স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়াকে পুনরুজ্জীবিত করত। বিষয়টি বুঝতে হলে মনে রাখতে হবে-ইসরায়েলের প্রতিটি পদক্ষেপ পরিচালিত হয় একটিমাত্র চূড়ান্ত লক্ষ্যে : ১৩০ বছরের পুরোনো জায়নবাদী প্রকল্প বাস্তবায়ন, অর্থাৎ পুরো ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনজুড়ে একটি ‘বৃহত্তর ইহুদি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা এবং সেটিকে আরব বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বীকৃত রাজনৈতিক বাস্তবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

৭ অক্টোবরের হামলা সেই স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়ায়, এমন সময়েই নেতানিয়াহু জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিচ্ছিলেন, ‘আব্রাহাম চুক্তি এক নতুন শান্তির যুগের সূচনা করেছে। আমি বিশ্বাস করি, আমরা এক ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তির দ্বারপ্রান্তে-ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে। এটি আরব-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের অবসানে বড় ভূমিকা রাখবে। এই প্রক্রিয়াকে পুনরায় সচল করতে নেতানিয়াহুকে দুটো লক্ষ্য পূরণ করতে হতো।

প্রথমত, তিনি এমন এক আঞ্চলিক বাস্তবতা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন, যেখানে আরব দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে উন্নতির সুযোগ পায়, এবং যার জন্য প্রয়োজন একটি ‘শান্তিপূর্ণ অঞ্চল’-যেমনটি একটি সামরিক আধিপত্যবাদী শক্তির দায়িত্ব। এজন্য নেতানিয়াহু ইরানের ‘প্রক্সি হিজবুল্লাহ ও হুথিদের সামরিক সক্ষমতা নস্যাৎ করতে উদ্যোগী হন (এখনো চলমান), পাশাপাশি ইরানের মদদপুষ্ট, মুসলিম ব্রাদারহুডঘনিষ্ঠ হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতে সচেষ্ট হন-যা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামকে জিইয়ে রেখেছে। এরপর সরাসরি ইরানকে মোকাবিলা করে তিনি সৌদি আরবের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকেও নিষ্ক্রিয় করতে চেয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ইসরায়েল আবারও নিজেদের ‘অপরিহার্য আঞ্চলিক প্রতিনিধি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

দ্বিতীয়ত, নেতানিয়াহুর মূল লক্ষ্য ছিল-ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে সম্পূর্ণরূপে দমন করা। ফিলিস্তিনিদের এমন এক বাস্তবতায় ঠেলে দেওয়া, যেখানে তারা ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনজুড়ে একটি ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ মেনে নিতে বাধ্য হয়। যদিও কিছু প্রতীকী ‘ফিলিস্তিনি অধিকার’ দেখানোর প্রয়োজন রয়েছে। তথাকথিত ‘দুই-রাষ্ট্র সমাধান’ এখানে একটি খন্ডিত, প্রায়-সার্বভৌম অথচ কার্যত অকার্যকর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র-যা একটি বর্ণবাদী ইসরায়েলের উপনিবেশে পরিণত হবে। আরব শাসকদের কাছে এটি যথেষ্ট, নিজ দেশের জনগণের মতো তারা গণতান্ত্রিক ও প্রতিরোধী ফিলিস্তিনিদের প্রতিও খুব একটা সহানুভূতি পোষণ করে না এবং এই দীর্ঘস্থায়ী সংকট থেকে যে কোনো উপায়ে সরে যেতে চায়। তবে ইসরায়েলের চলমান গণহত্যা, বাস্তুচ্যুতি ও দখলদারি আরব ও মুসলিম বিশ্বে তীব্র জনরোষ তৈরি করছে, যা স্বাভাবিকীকরণের পথে বড় বাধা।

সৌদি আরব এখনো আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দিতে চায়, তবে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ অব্যাহত থাকলে তা সম্ভব নয়। তাই ইসরায়েল এমন এক ‘প্রতিরোধবিহীন নিস্তব্ধতা’ তৈরির চেষ্টা করছে, যেখানে ফিলিস্তিনি সংগ্রাম দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। এই লক্ষ্যেই গাজা ও পশ্চিম তীরে গণহত্যার মতো অভিযান চালানো হচ্ছে, যেটি এক অর্থে স্বাভাবিকীকরণের পূর্বশর্ত। ইরান ও তাদের প্রভাববলয় থেকে হামাসকে বিচ্ছিন্ন করে, এই শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিরোধকেই নির্মূল করা হচ্ছে; যাতে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এক নতুন ক্ষমতার সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। ইরানে এই হামলা ছিল এই বিস্তৃত কৌশলগত অভিসন্ধিরই সরাসরি প্রয়াস।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫