
ইরানের ওপর ইসরায়েলের চলমান সামরিক হামলা মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম গুরুতর আঘাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি কেবল ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি বা পারমাণবিক স্থাপনার বিরুদ্ধে সীমিত কোনো অভিযান নয়; বরং এর আওতায় রয়েছে উচ্চপদস্থ ইরানি কমান্ডারদের লক্ষ্য করে পরিচালিত হত্যাকাণ্ড এবং উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন সাইবার হামলা। এ পর্যন্ত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাগেরী, আইআরজিসির প্রধান হোসেন সালামি এবং ইরানের বিমান ও মহাকাশ বাহিনীর প্রধান আমির আলি হাজিজাদেহর নিহত হওয়া। ইরানের সামরিক নেতৃত্বের ওপর এটি ১৯৮০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় আঘাত।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে এই হামলাকে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন রোধে প্রাক-প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রচার করলেও এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য অনেক গভীর-ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করে ধ্বংস করা। দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলি এবং কিছু মার্কিন কৌশলবিদ মনে করেন, ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাক্সক্ষা দমন করতে হলে চূড়ান্তভাবে প্রয়োজন ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা সরকারের পতন। বর্তমান অভিযান সেই পুরোনো লক্ষ্য বাস্তবায়নের নতুন রূপÑসামরিক আঘাতের পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপ প্রয়োগ।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো স্পষ্ট করে দিচ্ছে, এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল ইরানের অভ্যন্তরে গণবিক্ষোভের প্রাথমিক তরঙ্গ উসকে দেওয়া। এই কৌশল পরিচিত-শীর্ষ সামরিক নেতাদের হত্যা, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, গুজব ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো এবং রাষ্ট্রীয় প্রতীক ও অবকাঠামোর ওপর প্রতীকী হামলা।
তেহরানে ইসরায়েল সমর্থিত সাইবার আক্রমণ ও নির্ভুল ড্রোন হামলা সরকারি দপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে, এমনকি সাময়িকভাবে জাতীয় টেলিভিশনের সম্প্রচারও বন্ধ করে দেওয়া হয়, যা ইসলামি প্রজাতন্ত্রের তথ্যপ্রবাহের অন্যতম কেন্দ্র। গোপন ব্রিফিং ও বাছাই করা মিডিয়া সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, ইরানের যে পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ঝাগরস ও আলবরজ পর্বতের নিচে প্রায় ৫০০ মিটার গভীরে অবস্থিত, সেগুলো ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। বিশেষ করে, এই অভিযানে প্রয়োজন জিবিইউ-৫৭ ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনেট্রেটর’ বোমার, যা শুধু আমেরিকার বি-টু বা বি-ফিফটি টু বোমারু বিমানে বহনযোগ্য। এই সক্ষমতা ছাড়া ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম থামানো সম্ভব নয়, এমনটাই বিশ্বাস ইসরায়েলি নেতৃত্বের।
ইসরায়েল লবির চাপে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ইরানের অন্তত তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা এখনো অনিশ্চিত, তবে রাজনৈতিক অভিঘাত মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রতিফলিত হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। হামলার পর ইসরায়েলি প্রচারণা মেশিন আরো সক্রিয় হয়েছে। তাদের বার্তায় আইআরজিসিকে ‘জাতীয় রক্ষাকারী’ নয়, বরং ‘জনগণের নিপীড়ক’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ‘এটি ইরানের যুদ্ধ নয়, এটি সরকারের যুদ্ধ।’ বিদেশে অবস্থানরত বিরোধী নেতারা যেমনÑশেষ শাহের ছেলে রেজা পাহলবি এবং সাবেক ফুটবলার আলি করিমিÑএই বার্তা পুনরাবৃত্তি করে হামলার সমর্থনে ও সরকার পরিবর্তনের আহ্বান জানাচ্ছেন। তবে এই কৌশলের ফল উল্টো হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
জনগণের মধ্যে ক্ষোভ, বিভ্রান্তি বা বিক্ষোভ ছড়িয়ে দেওয়ার বদলে এই হামলা ইরানিদের মাঝে বিরল ঐক্য গড়ে তুলছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের বিরোধিতা করতেন, তারাও বিদেশি আগ্রাসনের প্রতিবাদ করছেন। ১৯৫৩ সালের সিআইএ-সমর্থিত অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ইরান-ইরাক যুদ্ধ পর্যন্ত বহুবারের বহিরাগত হস্তক্ষেপের স্মৃতি জনমনে প্রতিরোধের এক ঐতিহাসিক চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছে।
এমনকি ২০২২ সালে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুকে ঘিরে গড়ে ওঠা ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারাও এখন এই হামলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বোমাবিধ্বস্ত ভবন ও মৃত সেনাদের ছবি ছড়িয়ে পড়ায় ইরানিদের মধ্যে এক ধরনের সহানুভূতির ঢেউ দেখা যাচ্ছে, যা রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিকে পেছনে ঠেলে জাতীয় সংহতির অনুভূতিকে সামনে এনেছে।
এ প্রসঙ্গে আরো গুরুত্বপূর্ণ যে, অনেক প্রভাবশালী এবং আগের সরকারের বিরোধিতাকারীও ইরানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করেছেন। ফুটবল কিংবদন্তি আলি দাই বলেছেন, ‘আমি মরে যেতে পারি, কিন্তু দেশদ্রোহী হতে পারি না।’ সাবেক বিচারক ও রাজনৈতিক বন্দি মোহসেন বোরহানি লিখেছেন, ‘আমি দেশরক্ষাকারীদের হাত চুম্বন করি।’ এই কথাগুলো মূলত আইআরজিসি ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি সংহতির প্রকাশ।
যে হামলা কৌশলগতভাবে সরকারের ভিত নড়বড়ে করতে চেয়েছিল, তা এখন জাতীয় ঐক্য গঠনে সহায়ক হয়ে উঠছে। বাইরের চাপ ও আঘাতে ভেতরে বিপ্লব ঘটানোর প্রয়াস এখানে ব্যর্থ হয়েছে; বরং উল্টো প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ইসরায়েল যদি ভেবে থাকে এই আক্রমণ সরকার পতনের পথ প্রশস্ত করবে, তাহলে তারা হয়তো ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও জাতীয় সংকটের সময় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ঐতিহাসিক প্রবণতাকে অবমূল্যায়ন করেছে। জেনারেলরা মারা যাচ্ছেন, বোমা পড়ছে, কিন্তু ইরানের সামাজিক বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে না, বরং তা আরো দৃঢ় হচ্ছে।