Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

যুদ্ধের চোরাবালিতে ইসরায়েলের অর্থনীতি

Icon

তৌসিফ আহমেদ

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২৫, ১৫:০০

যুদ্ধের চোরাবালিতে ইসরায়েলের অর্থনীতি

যুদ্ধরত ইসরায়েলি সেনা।

যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের মধ্যস্থতায় ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ১২ দিনের যুদ্ধ আপাতত থেমেছে। মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদের ছড়ি ঘুরিয়ে, ফিলিস্তিনের গাজায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে নিজেকে অজেয় ভাবা ইসরায়েলের জন্য এবার ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াই যেন কাল হয়ে দাঁড়ায়। এই সংঘাত ইসরায়েলের শক্তিশালী অর্থনীতিতে সৃষ্টি করেছে গভীর ক্ষত। এমনিতেই একসময়কার স্থিতিশীল ও প্রযুক্তিনির্ভর ইসরায়েলি অর্থনীতি দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা গাজা যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান ব্যয়, নজিরবিহীন জনবলের সংকট এবং বিনিয়োগে ধসের কারণে এক সংকটের চোরাবালিতে আটকে গিয়েছিল। সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে নতুন এই সামরিক উত্তেজনা দেশটির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। ইরান যুদ্ধের সবচেয়ে বড় এবং তাৎক্ষণিক ধাক্কাটি এসেছে ইসরায়েলের শ্রমবাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর। 

ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ লিয়াম পিচের মতে, ইসরায়েলের অর্থনীতি একটি মারাত্মক ‘সরবরাহ-পার্শ্বিক ধাক্কার’ শিকার হয়েছে, যার প্রভাব হবে অত্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী। তার মতে, এই যুদ্ধের কারণে আগামী কয়েক বছরে ইসরায়েলের অর্থনীতি তার যুদ্ধপূর্ব অবস্থার চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ ছোট হয়ে যাবে, যা দেশটির কয়েক দশকের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ম্লান করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই সংকটের মূল কারণ হলো যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রায় তিন লাখ রিজার্ভ সেনাকে ডেকে পাঠানো। এই রিজার্ভ সেনারা কোনো সাধারণ কর্মী নন; তাদের একটি বড় অংশই ইসরায়েলের গর্বের প্রতীক-এর প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও পরিষেবা খাতের অত্যন্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মী। এই ‘ব্রেন ড্রেন’-এর ফলে দেশটির উদ্ভাবনী এবং উচ্চমূল্যের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রযুক্তি সংস্থাগুলো তাদের প্রকল্প বিলম্বিত করতে বাধ্য হচ্ছে, আন্তর্জাতিক চুক্তি পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে এবং নতুন গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করার ক্ষমতা হারাচ্ছে। 

একই সঙ্গে নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের ইসরায়েলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে দেশটির নির্মাণ ও কৃষি খাতে এক তীব্র শ্রমিক সংকট তৈরি হয়েছে, যা একদিকে আবাসন খাতকে পঙ্গু করে দিচ্ছে এবং অন্যদিকে কৃষিপণ্যের উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। 

যুদ্ধের বিধ্বংসী প্রভাব ইসরায়েলের প্রধান অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে যেখানে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ঈর্ষণীয় ৬.৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে তা উদ্বেগজনকভাবে কমে ২ শতাংশে নেমে আসে। ২০২৪ সালের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস আরো আশঙ্কাজনক, মাত্র ০.৭ শতাংশ থেকে ১.৫ শতাংশের মধ্যে। এটি প্রমাণ করে, দেশটির অর্থনীতির চাকা প্রায় থেমেই গেছে। 

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চিত্রটি আরো ভয়াবহ। ব্যাবসায়িক বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ৬৮ শতাংশ, যা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের ইসরায়েলের বাজারে আস্থাহীনতার সুস্পষ্ট প্রতিফলন। অন্যদিকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রতিরক্ষা ব্যয় বেড়েছে ৬০ শতাংশেরও বেশি। এর ফলে যুদ্ধপূর্ব ০.৬ শতাংশ বাজেট উদ্বৃত্তের পরিবর্তে ইসরায়েল এখন জিডিপির ৬ শতাংশেরও বেশি বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন। এই বিপুল ঘাটতি মেটাতে সরকারকে দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে বিপুল পরিমাণে ঋণ করতে হচ্ছে, যা কেবল সুদের বোঝাই বাড়াচ্ছে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর একটি দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের আঁচ কেবল ইসরায়েলের সীমানায় সীমাবদ্ধ নেই, এর ঢেউ আছড়ে পড়ে বিশ্ব অর্থনীতিতেও। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে জ্বালানি তেলের বাজারে। বিশ্বের অন্যতম তেল সরবরাহকারী রুট হরমুজ প্রণালি ইরানের প্রভাববলয়ে থাকায় যেকোনো বড় আকারের সংঘাত বৈশ্বিক তেল সরবরাহব্যবস্থাকে মুহূর্তের মধ্যে বিপর্যস্ত করতে পারে, যার ফলে বিশ্বজুড়ে জ্বালানির দাম বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এর পাশাপাশি লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর চলমান হামলা এবং সম্ভাব্য সংঘাতের কারণে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন এরই মধ্যে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জাহাজগুলোকে দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল পথে চলতে বাধ্য হওয়ায় পণ্যের দাম বাড়ছে। 

পরিশেষে বলা চলে, দক্ষ জনবলের অভাব, বিনিয়োগে ঐতিহাসিক ধস, আকাশচুম্বী প্রতিরক্ষা ব্যয় এবং বৈশ্বিক বাজারের অনাস্থাÑএর সবকিছু মিলিয়ে ইসরায়েলের অর্থনীতি এক গভীর সংকটের আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হবে, এই অর্থনৈতিক ক্ষত তত গভীর হবে এবং দেশটির ‘স্টার্ট-আপ নেশন’ হিসেবে পরিচিতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই চোরাবালি থেকে পুনরুদ্ধার করা ইসরায়েলের জন্য অত্যন্ত কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ একটি চ্যালেঞ্জ হবে, যার সাফল্য শুধু সামরিক বিজয়ের ওপর নয়, বরং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের ওপরও নির্ভর করবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫