
ইসরায়েলি এজেন্ট আবু শাবাব। ছবি : সংগৃহীত
গত ৫ জুন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক ভিডিও বার্তায় যা বললেন, তা গাজাবাসীর কাছে নতুন নয়, কিন্তু বিশ্বের কাছে তা ছিল বিস্ময়কর স্বীকারোক্তি। তিনি প্রকাশ্যে জানালেন, ইসরায়েল গাজার কিছু শক্তিশালী গ্রুপ ও সশস্ত্র গ্যাংকে অস্ত্র দিচ্ছে। এই ঘোষণায় শুধু একটি সামরিক কৌশল নয়, প্রকাশ পেল এক ভয়ংকর রাজনৈতিক প্রকল্প-গাজার সমাজকে ভেতর থেকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার পরিকল্পনা। নেতানিয়াহুর মতে, এই ‘সাহায্য’ দেওয়া হচ্ছে ইসরায়েলি সেনাদের প্রাণহানি কমাতে। তবে বাস্তবে গাজার জনগণের জন্য এর অর্থ দাঁড়িয়েছে আরো ভয় ও অনিশ্চয়তা এবং নিজেদের মধ্যেই জন্ম নেওয়া গভীর অবিশ্বাস।
গাজাবাসী এখন কেবল আকাশ থেকে নামা বোমা নয়, তাদের চারপাশে ঘোরাফেরা করা মানুষগুলোকেও ভয় পাচ্ছে। যে সমাজ একসময় ঈদের রাতে পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়াত, নিরাপদে রাত গভীর করে ঘরে ফিরত, সেখানে এখন দিনেদুপুরেও কেউ তাঁবু থেকে বেরোতে সাহস করে না। গাজায় অবস্থান করা ফিলিস্তিনি নারী সাংবাদিক নূর এলআসি বলেন, ‘সশস্ত্র গ্যাংগুলোর উপস্থিতি আমাদের জীবনে এক নতুন স্তরের আতঙ্ক যোগ করেছে। যাদের অনেকেই হত্যাকাণ্ড, মাদক পাচার কিংবা ইসরায়েলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে কারাবন্দি ছিল। তাদের এখন রাস্তায় রাইফেল হাতে দেখা যায়। তারা শুধু লুটপাটে লিপ্ত নয়, বরং পুরো ত্রাণ ব্যবস্থাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে।’
‘ইসরায়েলি এজেন্ট’ আবু শাবাব
ইসরায়েলের ছায়াতলে গড়ে ওঠা এসব বাহিনীর মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন ইয়াসের আবু শাবাব, রাফাহর এক গ্যাংলিডার। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যখন হামাস ইসরায়েলে হামলা চালায়, তখনো গাজার কারাগারে মাদক মামলায় বন্দি ছিলেন তিনি। যুদ্ধ শুরু হতেই রহস্যজনকভাবে মুক্ত হন এবং অল্প সময়ের মধ্যে গঠন করেন ‘অ্যান্টি-টেরর সার্ভিস’ নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী, যার সদস্য সংখ্যা শতাধিক।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, তারা এই বাহিনীকে কৌশলগতভাবে অস্ত্র দিয়েছেÑহামাসকে দুর্বল করার লক্ষ্যে। কিন্তু এই পদক্ষেপ কেবল সশস্ত্র সংঘর্ষই বাড়ায়নি, গাজাকে ঠেলে দিয়েছে এক ধরনের গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। অন্যদিকে আবু শাবাব দাবি করেন, তিনি ‘মানবিক কাজ’ করছেন, ‘ত্রাণসামগ্রী রক্ষা করছেন’। অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, তার বাহিনী ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে একই এলাকায় কাজ করছে, ত্রাণবাহী ট্রাক থামিয়ে চালককে মারধর করছে, পণ্যের বস্তা লুট করছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও তার বক্তব্যে ধরা পড়েছে পরস্পরবিরোধী ও বিভ্রান্তিকর তথ্য।
এক সাক্ষাৎকারে আবু শাবাব বলেন, ‘আমরা কিছু ট্রাক নিয়েছি, যাতে খেতে পারি।’ অথচ পরে আবার বলেন, ‘আমরা কিছুই নিই না।’ তার এই দ্বৈত ভাষ্য ইঙ্গিত দেয়-গাজায় ‘ত্রাণ’ এখন আর দয়া নয়, বরং অস্ত্র হয়ে উঠেছে নিয়ন্ত্রণের।
লুটপাটের বাজারে ত্রাণ
গাজার উপত্যকায় এখন ত্রাণসামগ্রী পাওয়া মানেই মৃত্যুকে ডেকে আনা। যারা ক্ষুধার্ত, তারা জানে-ত্রাণ সংগ্রহ করতে গেলে কেবল গুলির মুখেই পড়তে হয় না, পড়ে যেতে হয় সশস্ত্র লুটেরাদের হাতেও। জাতিসংঘের খাদ্যবাহী ট্রাকগুলোকে থামিয়ে গ্যাং সদস্যরা চালককে মারধর করছে, মালামাল নিয়ে গিয়ে বাজারে বিক্রি করছে চার-পাঁচ গুণ দামে। এক বস্তা আটা ৮৫০ শেকেলে (প্রায় ২৪০ ডলার) বিক্রি হচ্ছে, যেখানে একসময় তা ছিল নিছক মৌলিক অধিকার।
বিচ্ছিন্নতার নীরব যন্ত্রণা
ইসরায়েলি হামলায় যখন গাজার টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে, তখন শুধু ইন্টারনেট নয়, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পুরো সমাজ। পরিবার একে অপরকে খুঁজে পায় না, সাংবাদিকরা মাঝপথে সংযোগ হারান, আহতদের কাছে পৌঁছাতে পারে না অ্যাম্বুলেন্স। এই ‘ব্ল্যাকআউট’ কোনো প্রযুক্তিগত বিপর্যয় নয়-এটি এক সচেতন কৌশলÑগাজার রক্তাক্ত বাস্তবতাকে অদৃশ্য করে দেওয়া। যখন বিশ্ব তাকায় অন্যদিকে, তখন গাজায় মৃত্যু বাড়ে। এই নীরবতা আমাদের অস্তিত্বকে গ্রাস করে।
পরিকল্পিত মৃত্যু, নির্মম থিয়েটার
জাতিসংঘ বলছে, গাজা দুর্ভিক্ষের মুখে। অথচ বাস্তবে এটি দুর্ভিক্ষ নয়, এটি পরিকল্পিত মৃত্যুর মঞ্চায়ন। এক মা জানালেন, তার সন্তানরা দুই দিন পর পর খায়, কখনো শুধু নোনা পানি খেয়ে থাকে। দূষিত পানি, অনাহার, সংক্রমণে শিশুরা ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তথাকথিত ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে গুলি করে মারা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে-কখনো পিঠে, কখনো মাথায়। মৃতদেহ পড়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সাহায্য করতে গেলেও গুলি চলে। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত ৪০০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, আহত হয়েছে সহস্রাধিক-শুধু খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে। যেখানে সাহায্য আসার কথা জীবন বাঁচাতে, সেখানে মৃত্যু হচ্ছে ত্রাণের জন্য দাঁড়াতে গিয়ে।
এই মৃত্যু কোনো ‘দুর্ঘটনা’ নয়। এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদিত হত্যা। এই ত্রাণ মানবিকতা নামে এক নিষ্ঠুর অভিনয়, যা ক্যামেরার সামনে সাজানো হয়, আর পেছনে রক্ত শুকিয়ে যায়। গাজায় সংঘাত শুধু শারীরিক নয়, সামাজিক ও মানসিক স্তরেও ছড়িয়ে পড়েছে। নূর এলআসি বলেন, “এখন একজন বাবা যদি পরিবারের জন্য রুটি আনতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা যান, তাহলে আমরা কাকে দোষ দেব? ত্রাণ যদি হয় প্রাণনাশের ফাঁদ, যদি ধনী রাষ্ট্রগুলো তাদের অর্থ দিয়ে এই হত্যাকে সম্ভব করে তোলে, তাহলে কি আমরা এটিকে সহায়তা বলতে পারি? এই যুদ্ধ এখন আর কেবল হামাস বনাম ইসরায়েল নয়। এটি একটি গণমানুষের সমাজকে টুকরো করে দেওয়ার যুদ্ধ। এটি আর শুধু ধ্বংস নয়, এটি একটি জাতির অস্তিত্ব মুছে ফেলার প্রয়াস। গাজায় বসবাসকারীদের জন্য এটি যুদ্ধ নয়। এটি সম্পূর্ণ এক ‘নির্মূল অভিযান’।”